কোথাও এলাকায় ঘুরছে পুলিশ। মাইক ফুঁকে বলছে, ধর্মঘটে ভয় পাবেন না, দোকান খোলা রাখুন! কোথাও জোর করে ধর্মঘটীদের প্রচার গাড়ি থামিয়ে সেটা টেনে নিয়ে আসছে থানায়। সরকারি কর্মীদের তো ধর্মঘটে না এলে বেতন ছাঁটাইয়ের হুঁশিয়ারি দেওয়াই হয়েছে। এমনকী, কলকাতায় যে সব সরকারি কর্মী এ দিন নিজের দফতরে রাত কাটাচ্ছেন, তাঁদের অভিজ্ঞতা: রীতিমতো নাম ধরে ধরে ‘রোল কল’ করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবারের সাধারণ ধর্মঘট রুখতে এতটাই মরিয়া শাসক দল।
পাল্টা হুঙ্কার ছেড়ে এককাট্টা বিরোধীরাও অফিস-আদালত-দোকানপাট বন্ধ করে, গাড়ির চাকা থামিয়ে যে কোনও মূল্যে ধর্মঘট সফল করতে নেমে পড়েছেন রাস্তায়।
ধর্মঘটের আগের দিন সব মিলিয়ে কার্যত যুদ্ধের বাতাবরণ কলকাতা-সহ গোটা রাজ্যে।
বন্ধ-ধর্মঘটে বেতন বা চাকরি ছাঁটাইয়ের মতো হুঁশিয়ারি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার এর আগে দিয়েছে। কিন্তু পুলিশ নামিয়ে এ ভাবে ধর্মঘট-বিরোধী প্রচার যে অভিনব, সেটা মানছেন প্রশাসন থেকে বিরোধী, সকলেই। এমনকী পুলিশমহলও।
ধর্মঘট প্রতিহত করতে রাজ্য প্রশাসন যে কোমর বেঁধে নামবে, সেটা মঙ্গলবারই জানিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন রাজ্য সচল রাখার। বুধবার সকাল থেকেই দেখা যায়, ধর্মঘট-বিরোধী প্রচারে সক্রিয় হয়ে উঠেছে পুলিশ। রাজ্যের সব থানা এলাকাতেই মাইক বাজিয়ে প্রচার চলেছে। বাঁকুড়া শহরে বামফ্রন্টের একটি প্রচার গাড়ি বেরিয়েছিল। পুলিশ সেটি আটক করলে ধর্মঘটীরা থানায় বিক্ষোভ দেখান। পুলিশ
পরে গাড়িটি ছেড়ে দিলেও বাঁকুড়ার পুলিশ সুপার নীলকান্ত সুধীর কুমার বলেছেন, ‘‘জোর করে কাউকে ধর্মঘটে সামিল করা বা উৎসাহিত করায় নিষেধাজ্ঞা আছে। তাই প্রচার গাড়ি আটক করা হয়েছিল।’’
বস্তুত, পুলিশকে পথে নেমে ধর্মঘট-বিরোধী প্রচার করতে হবে— এই নিয়ে উপরমহল থেকে নির্দেশ এসেছে এ বারে। কলকাতা পুলিশের সদর দফতর লালবাজার থেকে এই মর্মে একটি ই-মেল এর মধ্যেই সব থানায় পৌঁছে গিয়েছে। প্রচারের বয়ান— প্রশাসনের তরফে সমস্ত মানুষ ও সংস্থার কাছে আবেদন, ৩০ এপ্রিল ধর্মঘট পালন না করে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বজায় রাখুন। প্রশাসন পাশে রয়েছে। সেই মেল পেয়ে দক্ষিণ শহরতলির এক থানার অফিসারের মন্তব্য, ‘‘অনেক বছর চাকরি করছি। ধর্মঘট ব্যর্থ করতে সরকার কখনও পুলিশকে মাইক হাতে পথে নামায়নি!’’
প্রশাসনিক কাজে বুধবার মুখ্যমন্ত্রী নদিয়ায় ছিলেন। সেখানেও তিনি বলেন, ‘‘যাদের কাজকর্ম নেই, ঠান্ডা ঘরে থাকে, রাস্তার ধুলো মাখে না, মানুষের সঙ্গে দেখা করে না, তারাই হঠাৎ করে ধর্মঘট ডেকে দিল। ধর্মঘট করতে করতে মানুষের হৃদয় যদি বন্ধ হয়ে যায় তা হলে মানুষের জীবন চলে যায়।’’ তাঁর দাবি, ‘‘কাল (বৃহস্পতিবার) বাংলায় ধর্মঘট হচ্ছে না। কলকাতায়ও হচ্ছে না।’’ এবং আহ্বান, ‘‘হাতজোড় করে বলছি, ধর্মঘটকে সমর্থন করবেন না। দোকান-বাজার খোলা রাখুন, স্কুল-হাসপাতাল খোলা রাখুন।’’
মুখ্যমন্ত্রীর বন্ধ-ধর্মঘট বিরোধী অবস্থান নতুন নয়। ক্ষমতায় আসার কিছু আগে থেকেই তিনি ‘কর্ম সংস্কৃতি ও উন্নয়নের স্বার্থে’ ধর্মঘটের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। বর্তমান বিরোধীদের অবশ্য অভিযোগ, তার আগে দীর্ঘদিন নিজেই বন্ধের রাজনীতিই করেছেন তিনি। এখন কিন্তু সেই মমতাই ধর্মঘট রুখতে কোনও চেষ্টাই বাকি রাখছেন না। তাঁরই নির্দেশে এ দিন সমস্ত সরকারি এবং আধা-সরকারি কর্মচারীদের বৃহস্পতিবার অফিসে হাজির থাকার নির্দেশ বের করেছে অর্থ দফতর। তাতে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, ধর্মঘটে অফিসে না এলে এক দিনের বেতন কাটা হবে। ওই সরকারি নির্দেশকে ‘বস্তাপচা’ ও ‘অসাংবিধানিক’ আখ্যা দিয়ে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, ‘‘২০১২-তেও মুখ্যমন্ত্রী এই নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু আদালতে তা বৈধতা পায়নি।’’ তাঁর বক্তব্য, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী অযৌক্তিক ভয় দেখাচ্ছেন। এ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রুলিং আছে। যাঁরা ধর্মঘট করবেন কোনও ভাবেই তাঁদের চাকরিতে ছেদ পড়বে না।’’ বিরোধী দলনেতার হুঁশিয়ারি, ‘‘আমরা বলপ্রয়োগ করে ধর্মঘটের বিরুদ্ধে। যাঁর ইচ্ছে ধর্মঘট করবেন। যাঁর নেই করবেন না। কিন্তু সরকার যদি জোর করে ধর্মঘট ভাঙতে যায় তার ফল ভাল হবে না।’’ আর সিটুর রাজ্য সভাপতি শ্যামল চক্রবর্তীর বক্তব্য, ‘‘সরকার যুদ্ধ ঘোষণা করলে আমরাও পাল্টা যুদ্ধের জন্য তৈরি।’’
কর্মী-সমর্থকদের মাঠে নামতে বলেছে বিজেপিও। দলের রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ বলেন, ‘‘দলের কর্মীদের ভোর থেকে রাস্তায় থাকতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে কোনও রকম গণ্ডগোলেও জড়াতে নিষেধ করা হয়েছে। জোর খাটিয়ে নয়, আবেদন-নিবেদন করেই ধর্মঘট সফল করার কথা বলা হয়েছে কর্মী-সমর্থকদের।’’ তাঁর অভিযোগ, ‘‘ধর্মঘট ভাঙতে গুন্ডাবাহিনী নামাচ্ছে তৃণমূল।’’
এই অবস্থায় অশান্তির আশঙ্কা করছে প্রশাসন। এর মধ্যে ছোটখাটো সংঘর্ষও হয়েছে। পুলিশ জানাচ্ছে, ধর্মঘটের সমর্থনে প্রচারের সময় দুর্গাপুর ও রানিগঞ্জে সিপিএম এবং তৃণমূলের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে এ দিন নবান্নে স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের সব আইজি, ডিআইজি, এসপি এবং কমিশনারদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্স করে ধর্মঘটে জনজীবন স্বাভাবিক রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।
বিরোধীদের এ সব অভিযোগ অবশ্য মানতে চায়নি শাসক দল। তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বন্ধের বন্ধ্যা কাটাতে এবং জনজীবন সচল রাখতে মুখ্যমন্ত্রী অনুরোধ করেছেন। আমরাও চাই, কলকারখানা খোলা থাকুক, রাস্তাঘাটে গাড়ি চলুক, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় খোলা থাকুক।’’ আর রাজ্যের কৃষিমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু নবান্নেবলেছেন, ‘‘এসইউসি-র হরতাল-ধর্মঘট ঠেকাতে বাম সরকার কর্মীদের হাজির থাকার নির্দেশ জারি করেছিল। আমরা নতুন কিছু করিনি। সেটাই অনুসরণ করছি।’’
এই ধর্মঘটকে অসাংবিধানিক বলো ঘোষণা করার দাবি জানিয়ে জনস্বার্থ মামলাও হয়েছিল হাইকোর্টে। হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুরের ডিভিশন বেঞ্চ জানিয়ে দেয়, এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্ট ও কলকাতা-সহ নানা রাজ্যের হাইকোর্টের একাধিক নির্দেশ রয়েছে। তা সত্ত্বেও এই ধরনের ধর্মঘট ডাকা বন্ধ করেনি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। ডিভিশন বেঞ্চ জানিয়েছে, ধর্মঘটে জনজীবন স্বাভবিক রাখতে রাজ্য সরকার পুলিশ-প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছে। তাই নতুন করে কোনও নির্দেশ দিতে বেঞ্চ রাজি নয়।
সরকারি সূত্রের খবর, বৃহস্পতিবার বাড়তি বাস চালাবে পরিবহণ নিগম। বেসরকারি বাস, অটো ও ট্যাক্সি সংগঠনগুলিকেও অনুরোধ জানানো হয়েছে। সরকারের এই আর্জি মেনে রাস্তায় গাড়ি নামাতে রাজি হলেও নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ওই সব সংগঠনের কর্তারা। বেঙ্গল ট্যাক্সি অ্যাসোসিয়েশনের নেতা বিমল গুহ জানিয়েছেন, নিরাপত্তার দায়িত্ব সরকারের। বেসরকারি বাসমালিক সংগঠন জয়েন্ট কাউন্সিল অব বাস সিন্ডিকেটস-এর নেতা তপন বন্দ্যোপাধ্যায় আবার বলেন, ‘‘শ্রমিকরা না এলে আমাদের কিছু করার নেই।’’ তবে শাসক দলের ট্যাক্সিমালিক সংগঠনের নেতা শম্ভুনাথ দে জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা দিনভর ট্যাক্সি চালাবেন।
এত সবের পরেও অবশ্য সরকারি কর্মীরা বন্ধের সকালে যানবাহন পাওয়ার বিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে পারেননি। তাই খাদ্য ভবন, জেশপ বিল্ডিং, মহাকরণ এবং নবান্নেও এসে রয়েছেন তাঁরা। এঁদেরই কোনও কোনও দফতরে এসে রীতিমতো ‘রোল কল’ করেছেন ইউনিয়ন নেতারা। যা দেখে কেউ কেউ বলছেন, এ ধর্মঘট, নাকি যুদ্ধ!