ধোঁয়ায় ভরেছে আসানসোলের খনি অঞ্চল। নিজস্ব চিত্র
ভারতে কয়লাশিল্পের আঁতুড়ঘর রানিগঞ্জ-আসানসোল শিল্পাঞ্চল। রানিগঞ্জে কয়লা নিষ্কাশন শুরু হয় আজ থেকে প্রায় দু’শো তেতাল্লিশ বছর আগে। তখন ওই অঞ্চল ছিল ঘন জঙ্গলে ঢাকা। সেখানে বসতি ছিল আদি জনজাতি বাউরিদের আর সাঁওতাল-কোল-ভীলদের মতো আদিবাসীদের। প্রথম খনিশ্রমিক ছিলেন এঁরাই।
ক্রমে খনি বাড়ল, বাড়তে লাগল শ্রমিকের চাহিদা। উনিশশো বিশ ও তিরিশের দশকে খনি অঞ্চল নিয়ে শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের ‘কয়লাকুঠির দেশ’-এর ভাষায়, ‘কত দেশের কত লোক এসে জড়ো হয়েছে। ভারতবর্ষের নানা প্রদেশ থেকে নানা রকমের মানুষ এসেছে। মাটির নীচে পাওয়া গেছে অমূল্য সম্পদ। সেই সম্পদ আহরণ করার জন্য...’’।
কিন্তু এর পিছনে রয়ে গিয়েছে কত শোষণ আর অবিচারের ইতিহাস। ক্রমে কয়লাশিল্পের জয়পতাকা উড়তে লাগল ভারত-সহ বিভিন্ন দেশে। কিন্তু উপেক্ষিত রইল শ্রমিক-স্বার্থ, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা। তখন অনিবার্য ছিল খনিতে ধস, গ্যাসে আগুন লেগে বিস্ফোরণ ইত্যাদি দুর্ঘটনা। সে সব প্রাণহানির হিসেব ইতিহাস রাখেনি।
নানা রকম অসুখের মধ্যে পরাক্রম নিয়ে জায়গা করে নিল কয়লা-ধূলির দূষণজনিত অসুখ। সূক্ষ্ম কয়লারেণুর সঙ্গে শ্রমিকদের অস্বাস্থ্যকর সহবাস ফুসফুসের ক্ষতি করে জন্ম দিল বিভিন্ন অসুখের। কাশি, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি উপসর্গ নিয়ে খনি শ্রমিকেরা আক্রান্ত হতে লাগলেন ঘন ঘন ফুসফুসের সংক্রমণ
বা হাঁপানিতে।
কিন্তু ফুসফুসের যে অসুখটি ত্রাস হয়ে দাঁড়াল— যা পরে কুখ্যাত হল ‘নিউমোকোনিয়োসিস’ (PNEUMOCONIOSIS) নামে— বৃত্তিগত সেই অসুখটির প্রকৃতি বুঝে উঠতে সময় লাগল। ফুসফুসের অসুখে মৃত কয়লাখনি শ্রমিকদের দেহ ময়না-তদন্ত করে চিকিৎসকেরা দেখলেন, ফুসফুস কালো হয়ে রয়েছে। সাহেবরা প্রথমে এর নাম দিয়েছিলেন ‘ব্ল্যাক লাং ডিজিজ’। বাতাসে ০.৫ থেকে ৩ মাইক্রন আকারের যে কোনও ধূলিকণা বা রেণুতে দীর্ঘদিনের উন্মুক্তিই এই অসুখের কারণ।
এই অসুখ ধরা পড়ল অন্য শিল্প ক্ষেত্রেও— যেমন সোনা বা অভ্রখনিতে সিলিকার জন্য, বস্ত্রশিল্পে সুতো-রেণুর জন্য। ১৮৬৬ সালে জার্মান প্যাথোলজিস্ট জেন্ডার এর নাম দিলেন ‘নিউমোনোকোনিয়োসিস’। ১৮৭৪ সালে বৈজ্ঞানিক প্রাউস্ট এই নামটি পরিমার্জিত করে দিলেন নতুন স্থায়ী নাম, ‘নিউমোকোনিয়োসিস’, যার অর্থ ‘ধূমায়িত ফুসফুস’। কয়লা শিল্পে এই অসুখের নাম হলো ‘কোল ওয়ার্কার্স নিউমোকোনিয়োসিস’ (সিডব্লিউপি)।
উনিশশো শতকের প্রথম অর্ধেই নিউমোকোনিয়োসিস জায়গা করে নিয়েছিল গল্প, নাটক, হলিউডের সিনেমা ইত্যাদিতে। ১৯৩৯-এ ফ্যানি হার্স্ট-এর গল্প নিয়ে ওয়ার্নার ব্রাদার্সের সিনেমা ‘ফোর ওয়াইভ্স’-এর নায়ক এক জন ডাক্তার, যিনি ‘নিউমোকোনিয়োসিস’ নিয়ে গবেষণা করছেন। ১৯৪৫ সালে নোয়েল কাওয়ার্ডের নাটকে এল এই অসুখের প্রসঙ্গ।
১৯৩৫ সালে আমেরিকায় ‘ন্যাশনাল পাজলার্স লিগ’-এর সভায় সভাপতি ইভারেট স্মিথ উপহার দিলেন একটি দীর্ঘ শব্দ, যা আগ্নেয়গিরির সিলিকা-ধূলি থেকে হওয়া ‘নিউমোকোনিয়োসিস’-কে বোঝায়— ‘Pneumonoultramicroscopicsilicovolcano-coniosis’। পঁয়তাল্লিশ অক্ষরের শব্দটি জায়গা পেল অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে।
এর পরেও আমেরিকায় উনিশশো শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত ‘নিউমোকোনিয়োসিস’-এর অনিষ্টকারী রূপটি চিনে তার প্রতিবিধানের সে রকম কোনও উদ্যোগ চোখে পড়ে না। ১৯৬৯ সালে আমেরিকায় গঠিত হয় ‘ফেডারেল কোল মাইনিং হেল্থ অ্যান্ড সেফটি’ আইন এবং ‘ব্ল্যাক লাং ডিসেবিলিটি টেস্ট’। নিউমোকোনিয়োসিসের জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হল সমস্ত খনি-কর্তৃপক্ষ।
১৯৯০ সালেও ‘নিউমোকোনিয়োসিস’-এর কবলে পড়ে মারা যান প্রায় দু’লক্ষ ষাট হাজার শ্রমিক আর ‘সিডব্লিউপি’-তে আনুমানিক পঁচিশ হাজার জন।
পরাধীন ভারতবর্ষের খনিশ্রমিকদের এ সব ক্ষেত্রে অবহেলাই ছিল প্রাপ্তি। ভারতে ১৯৫৭ সালের সমীক্ষায় দেখা যায়, খনিশ্রমিকদের শতকরা ১৫ জন আক্রান্ত ‘সিডব্লিউপি’-তে। ভারতবর্ষে ১৯০১ সালে খনি আইন চালু হলেও তা গুরুত্ব পায় অনেক পরে, ১৯৫২ সালে। ১৯৫২ সালে খনি আইন অনুযায়ী, ‘সিডব্লিউপি’ একটি ‘নোটিফায়েবল ডিজিজ’ হিসেবে ঘোষিত হয়। ‘ওয়ার্কম্যানস কম্পেনসেশান অ্যাক্ট, ১৯৫৯’-এর দৌলতে এটি ক্ষতিপূরণযোগ্য অসুখ বলে আইনি স্বীকৃতি পায়।
১৯৭৩ সালে জাতীয়করণ হল কয়লাশিল্পের। কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রকের অধীন ‘ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ মাইন্স সেফটি’ (ডিজিএমএস)-র উপরে খনিশ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা তদারকির দায়িত্ব বর্তায়। ১৯৭৮ সালে খনিশ্রমিকদের প্রাথমিক ও নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা বাধ্যতামুলক হয়। কমতে থাকে ‘সিডব্লিউপি’-তে আক্রান্তের সংখ্যা। ১৯৬১ সালে কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রকের পাইলট সমীক্ষাতে ১৮.৫ শতাংশের ‘সিডব্লিউপি’ ধরা পড়লেও, ১৯৯৩-এ এক সমীক্ষায় তা দাঁড়ায় ২.৮৪ শতাংশে।
‘সিডব্লিউপি’ আজ বিলুপ্তপ্রায়। কিন্তু বায়ুদূষণজনিত অসুখের জন্মদাগ নিয়ে বেড়ে ওঠা এই শিল্পাঞ্চলে বায়ুদূষণ আজও একই রকম প্রাসঙ্গিক। কারণ, বিভিন্ন শিল্পের বেলাগাম দূষণ, খোলামুখ কয়লাখনির উপস্থিতি, যানবাহনের বহুল
এবং অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার, উন্মুক্ত স্থানে কয়লা আদি বস্তু জ্বালানো ইত্যাদি। সচেতনতা আর উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে এই শিল্পাঞ্চল দূষণমুক্ত হোক—সময়ের দাবি এটাই।
লেখক আসানসোলের চিকিৎসক