কীটনাশক-মুক্ত পরিবেশ-বান্ধব আমে বিদেশের বাজার ধরতে চায় মুর্শিদাবাদ

সামান্য একটা ফাঁদ। তাতেই কেল্লা ফতে! কীটনাশকের বিকল্প হিসাবে সেই ফাঁদ পেতেই পরিবেশবান্ধব আম ফলাচ্ছে মুর্শিদাবাদ। সামনের বছর থেকে তা বিদেশের বাজার ধরবে বলে উদ্যান পালন দফতর মনে করছে। বছর পাঁচেক আগে মুর্শিদাবাদের নবাবি আম নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি দিয়েছিলেন লালবাগের আমচাষি হায়াতুন নবি। উদ্দেশ্য, সুস্বাদু আম খাইয়ে সে দেশের ধনকুবেরদের মন জয় করে পেট্রোডলার আয় করা। তাঁর পরিকল্পনা অনেকটা সফলও হয়েছিল।

Advertisement

অনল আবেদিন

শেষ আপডেট: ০১ জুন ২০১৫ ০১:৩১
Share:

জৈব সারে চাষ করা পরিবেশবান্ধব আমবাগানে হায়াতুন নবি। ছবিটি তুলেছেন গৌতম প্রামাণিক।

সামান্য একটা ফাঁদ। তাতেই কেল্লা ফতে! কীটনাশকের বিকল্প হিসাবে সেই ফাঁদ পেতেই পরিবেশবান্ধব আম ফলাচ্ছে মুর্শিদাবাদ। সামনের বছর থেকে তা বিদেশের বাজার ধরবে বলে উদ্যান পালন দফতর মনে করছে।
বছর পাঁচেক আগে মুর্শিদাবাদের নবাবি আম নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি দিয়েছিলেন লালবাগের আমচাষি হায়াতুন নবি। উদ্দেশ্য, সুস্বাদু আম খাইয়ে সে দেশের ধনকুবেরদের মন জয় করে পেট্রোডলার আয় করা। তাঁর পরিকল্পনা অনেকটা সফলও হয়েছিল। কিন্তু বাদ সাধল আমের ভিতরে থাকা এক ধরনের কীট। দুবাইয়ে ৪০০ টাকা কেজি দরে আম বিক্রির হিড়িক আচমকাই মুখ থুবড়ে পড়েছিল। সেই অবস্থা থেকে শিক্ষা নিয়ে বাড়ি ফিরে কীটমুক্ত, পরিবেশবান্ধব আম চাষে মন দেন তিনি। যোগ্য সঙ্গত দেন জেলার উদ্যান পালন দফতরের সহ-অধিকর্তা শুভদীপ নাথ। তাঁদের উদ্যোগেই লালবাগের কিছু বাগানে এখন পরিবেশবান্ধব আম ফলছে।

Advertisement

মুর্শিদাবাদ জেলায় ২৩ হাজার হেক্টর জমিতে আম বাগান রয়েছে। উদ্যানপালন দফতরের উপ-অধিকর্তা গৌতম রায় জানান, এ বছর জেলায় আমের ফলন হয়েছে ৯৫ হাজার টন। কিন্তু সংরক্ষণ কেন্দ্র বা প্রক্রিয়াকরণ শিল্প গড়ে না ওঠায় সে ভাবে আমের দাম পাচ্ছেন না চাষিরা। আমচাষের পুরনো পদ্ধতির কারণে বিদেশেও ওই আম রফতানি করা সম্ভব নয়। ফলে পরিবেশবান্ধব আমচাষ এ বার সেই মুশকিল আসান করতে চলেছে। গৌতমবাবু জানান, আলফানসোর মতো এই জেলার আম রফতানিরও অসুবিধা আছে। এখানকার আবহাওয়া শুষ্ক নয়। সেই কারণেই আমে পোকা ধরে বেশি। কীটনাশকও বেশি প্রয়োগ করতে হয়। কিন্তু কীটনাশক ব্যবহার করা আম বিদেশে বিক্রি হয় না।

এমন পরিস্থিতিতে কল্যাণী কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রযুক্তি ও চাষের বিশেষ কিছু পদ্ধতি জেনে কয়েকজন উদ্যোগী বাগিচা চাষিকে সঙ্গে নিয়ে মাঠে নেমে পড়েন শুভদীপবাবু। তিনি বলেন, ‘‘আমের মিষ্টত্বের কারণে সাদা এক ধরনের কীটের খুব উপদ্রব হয়। সেই পোকা থেকে আমচাষ রক্ষা করতে মরসুমে ৪-৫ বার গাছের উপর কীটনাশক স্প্রে করতে হয়। তাতে স্বাদও কমে, বিদেশেও রফতানি করা যায় না।’’ ফলে কীট রুখতে কীটনাশক ব্যবহার না করে তৈরি করা হয় এক ধরনের ফাঁদ। কেমন সেই ফাঁদ?

Advertisement

শুভদীপবাবু জানিেয়ছেন, একটি মাঝারি মাপের বাটির সমান ওই ফাঁদ। তাতে থাকে মিথাইল ইউজিনল নামের ট্যাবলেট ও জল। গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে ওই ফাঁদে ধরা দিয়ে জলে ডুবে মারা যায় কীট। এক বিঘা আমবাগানে ২-৩টি ফাঁদ গাছে ঝুলিয়ে রাখলেই কেল্লা ফতে। কিন্তু শুধু এই ফাঁদ পেতেই পরিবেশবান্ধব আম মিলবে না।

আমচাষি হায়াতুন নবি জানান, পরিবেশবান্ধব আম পেতে রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমিয়ে বাগানে জৈব সারের ব্যবহার বাড়ানো হয়েছে। বাগান যাতে পরিষ্কার থাকে সে দিকে নজর রাখা হচ্ছে। আর এ সব কিছু করে ফলও মিলতে শুরু করেছে। শুভদীপবাবু জানিয়েছেন, মুর্শিদাদাবাদ হেরিটেজ ডেভলপমেন্ট নামে এক বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে পরিবেশবান্ধব আম এ বার কলকাতার বেশ কিছু রিটেল শপিং মলে রফতানি করা হয়েছে। আগামী বছর এই আম বিদেশেও পাড়ি দেবে। তিনি বলেন, ‘‘রাজ্য সরকারের আমমেলায় এবং দিল্লির প্রগতি ময়দানের আমমেলায় পরিবেশবান্ধব আম নিয়ে গিয়ে প্রচার করা হবে। ভিন্‌রাজ্যে এ জেলার সুস্বাদু আম রফতানি করার জন্য হেরিটেজ ডেভেলপমেন্ট কমিটি উদ্যোগী।’’

আরও একটি সংকটে ভুগছে মুর্শিবাদাবাদের নবাবি ঐতিহ্যের আম। নবাবদের চেষ্টায় এক সময় ২৫০ প্রজাতির আম ছিল। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে শ’খানেকে। প্রয়াত নবাব ওয়াসেফ আলি মির্জার অতি প্রিয় তোতা আমও আজ বিলুপ্ত। অথচ তোতা আম নিয়ে নবাবের সঙ্গে ইংরেজদের বিবাদ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল। হাজারদুয়ারির স্রষ্টা নবাব হুমায়ুন জাঁয়ের স্ত্রী বেগম রইসুন্নেসার নামে আড়াই বিঘার একটি আমবাগান ছিল। সেই বাগানের নাম রইসবাগ। রইসবাগে ছিল নবাব ওয়াসেফ আলি মির্জার বড় প্রিয় তোতা আম। লালবাগের গুলুবাবু নামের একজনকে রইসবাগ লিজ দিয়েছিলেন মুর্শিদাবাদ এস্টেট ম্যানেজার। শুনে নবাব রেগে গেলেন। ব্রিটিশ রাজের বোর্ড অব রেভিনিউ-এর সঙ্গে নবাবের দ্বন্দ্ব মেটাতে কমিশন গঠন করা হল। নবাবকে হতাশ করে কমিশনের রায় গেল গুলুবাবুর পক্ষেই। রাগে, ক্ষোভে, হতাশায়, অপমানে আর কোনও দিন তোতা আম ছুঁয়েও দেখেননি নবাব সৈয়দ ওয়াসেফ আলি মির্জা। সেই তোতা আমের আজ আর হদিস নেই।

হিমসাগর, গোবিন্দভোগ, মধুচূড়, লক্ষণভোগ, রানি, ভবানী, কোহিতুর, গোলাপখাস, বিমলি, রওগনি, চম্পা, চন্দন খোসা, বম্বাই, বিড়া, আনারস, নবাবপসন্দ, রানিপসন্দ, পাঞ্জাপসন্দ, সিন্দুরে—এমন শ’ খানেক প্রজাতির আম টিকে আছে। অবলুপ্ত আরও প্রায় দেড়শো প্রজাতির আম। লালবাগের নবাব পরিবারের অভিযোগ, কংগ্রেস আমলে মন্ত্রী আব্দুস সাত্তার থেকে প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু পর্যন্ত অনেকের কাছে দরবার করা সত্ত্বেও লুপ্তপ্রায় প্রজাতির আমগাছ রক্ষা করার জন্য ম্যাঙ্গো অ্যাম্পোরিয়াম গড়ে তোলা যায়নি। তবে এর মধ্যে আশার কথা একটাই, আমকে ভালবেসে নবাবি আমলের লুপ্তপ্রায় প্রজাতির সেই আম পুনরুদ্ধার করতে উদ্যোগী হয়েছেন লালবাগের উদ্ভিদ বিজ্ঞানের শিক্ষক মহম্মদ আলি, হায়াতুন নবির মতো কয়েকজন আম-আদমি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement