তহিরুদ্দিন। নিজস্ব চিত্র
পাড়া পড়শি থেকে গাঁ-গঞ্জ চুপি সাড়ে বলেন— ‘আমরা ওরে দ্যাখতি পাই না তো কী অইস্যে, ও আমাগো ঠিক দ্যাহে!’ ফেরার তহিরুদ্দিন মণ্ডলকে নিয়ে জলঙ্গির সীমান্ত গ্রামে এমন প্রবাদ রয়েছে।
খুনের দায়ে ফেরার তৃণমূলের সেই ব্লক সভাপতিকে দল থেকে বহিষ্কার করতে জেলা নেতাদের সময় লাগল পাক্কা সাত মাস। বৃহস্পতিবার তাকে শেষ পর্যন্ত ‘দলবিরোধী কাজের’ জন্য বহিষ্কারের পরে জেলা নেতাদের অনেকেই অস্বস্তি-মুক্ত হয়েছেন। কিন্তু এমন বিলম্ব কেন? উত্তর মেলেনি।
মাস খানেক আগে দলের জেলা সভাপতিকে কই প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘বহিষ্কারে বিলম্ব কেন?’ আবু তাহের খানের জবাব ছিল, ‘‘ও তো ফেরার। দলের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই তো!’’ জলঙ্গি জানে, দলীয় কার্যালয়ে তহিরের গদি আঁটা চেয়ারখানায় তবুও কেউ বসতে সাহস পেত না। তার কথা জিজ্ঞেস করলে চার পাশ তাকিয়ে স্থানীয় নেতরা বলতেন, ‘‘ও ছাড়েন, অন্য কথা বলেন।’’ প্রশ্নটা জেলা পুলিশের কাছে পাড়লে ধরা বাঁধা বয়ান ছিল, ‘খোঁজ চলেছে। তহির তো ফেরার!’ অথচ গ্রামবাসীদের অনেকেই সেই ফেরার নেতাকে কখনও সীমান্তের বর্ডার রোডে কখনও বা মোটরবাইকে মুখ ঢাকা অবস্থায় গ্রামের পথে দেখেছেন বলে দাবি। কেউ বা তাকে দেখেছেন কলকাতার ঝলমলে শপিং মলে। তবে, পুলিশ তার দেখা পায়নি। তৃণমূল থেকে সেই তহির-বিদায়ের পরে এ দিন জলঙ্গির চায়ের দোকানে পুরনো আড্ডায় নতুন করে ফিরে এসেছে প্রসঙ্গটা— ‘‘চুপ, তহির কিন্তু আমাগো কথা শুনত্যাসে!’’ ২৯ জানুয়ারি সাহেবনগরে দু’জন নিতান্ত আটপৌরে গ্রামবাসীকে খুন করে ফেরার হওয়ায় সাত মাস পরে দল থেকে তাকে বহিষ্কার করা হলেও তহিরের ‘মিথ’ এখনও ছায়ার মতো ঘুরছে এলাকায়।
আর তা যে নিছক প্রবাদ নয়, সাহেবনগর এলাকায় পা রাখলেই বোঝা যায়। ফেরার হওয়ার পরেও তার ইশারাতেই পঞ্চায়েত সমিতির টেন্ডার, গোপনে তোলাবাজি এমনকি দিন কয়েক আগে তার সাঙ্গোপাঙ্গরা নতুন করে এলাকার দলীয় কার্যালয় খুলে বসেছিল বলেও জানা গিয়েছে।
দলের স্থানীয় নেতাদের অনেকেই মনে করেন, দলীয় পর্যবেক্ষক শুভেন্দু অধিকারীর অনুগামী হওয়ারর সুবাদেই এত দিন টিঁকে ছিল তহির। জেলা থেকে সুভেন্দুর ছায়া সরতেই তাই কোপ পড়ল তার উপর। শুভেন্দু-ঘনিষ্ঠরা অবশ্য সে কথা মানছেন না। জেলা সভাপতি আবু তাহের খান বলেন, ‘‘আদতে আমাদের সাংগঠনিক প্রক্রিয়ার রদবদল হওয়ার কথা ছিল এই সময়, ফলে কিছুটা দেরি হয়েছে তাকে বহিষ্কার করতে। কিন্তু এটা ঠিক তার সঙ্গে আমাদের দলের কোনও সম্পর্ক ছিল না ওই খুনের ঘটনার পর।’’ জলঙ্গির ব্লক কংগ্রেস সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক মোল্লা বলছেন, ‘‘তহিরকে আদতে দলের একটা অংশ যেমন প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছিল তেমনই প্রশ্রয় পাচ্ছিল পুলিশের কাছ থেকে। বিধানসবা নির্বাচনের আগে নিজেদের ভাবমূর্তিকে স্বচ্ছ করতেই ওকে বহিষ্কার করা হল। তবে ওই এলাকায় দলের যা ক্ষতি হবার তা হয়ে গিয়েছে।’’ জলঙ্গির সিপিএম নেতা ইউনুস সরকার অবশ্য একে, ‘‘ভোটের আগে নতুন নাটক ছাড়া এটা আর কিছুই নয়’’ বলেই মনে করেন।
জেলার পুলিশ সুপার কে শবরী রাজকুমার তবুও বলছেন, ‘‘বহিষ্কারের সঙ্গে তদন্তের কোনও সম্পর্ক নেয়, আমরা ও খোঁজ চালিয়ে যাচ্ছি।’’