শব্দজব্দের ছক তৈরি, সমাধান হবে তো

অপেক্ষা ছিল শুধু সন্ধে নামার। আঁধার ঘনাতেই পটুয়াপাড়া থেকে মণ্ডপের পথে পথে প্রতিমাবাহী লরি, ভ্যানের স্রোত। সঙ্গে দোসর কান ফাটানো বাজির আওয়াজ।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ অক্টোবর ২০১৬ ০৩:৪৩
Share:

অপেক্ষা ছিল শুধু সন্ধে নামার। আঁধার ঘনাতেই পটুয়াপাড়া থেকে মণ্ডপের পথে পথে প্রতিমাবাহী লরি, ভ্যানের স্রোত। সঙ্গে দোসর কান ফাটানো বাজির আওয়াজ।

Advertisement

শুক্রবার শহরের এই পরিস্থিতি দেখে পুলিশের কপালে গভীর ভাঁজ পড়েছে। এ যদি মহড়া হয়, তা হলে আসল সময়ে ‘দানব’কে সামাল দেওয়া যাবে তো?

আজ, শনিবার কালীপুজো। আগামিকাল রবিবার দিওয়ালি। সোম-মঙ্গলবার ভাসান। এই চার দিন কলকাতা পুলিশ ও রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের সামনে কঠিন পরীক্ষা। যাতে সসম্মানে উতরোনো নিয়ে কর্তারা ঘোর সন্দিহান। কিন্তু অন্য বছরের তুলনায় এ বার তো কালীপুজোর আগে পুলিশ যথেষ্ট জোরদার অভিযান চালিয়েছে! প্রচুর শব্দবাজি বাজেয়াপ্তও হয়েছে! তা হলে চিন্তা কীসের?

Advertisement

লালবাজারের কর্তারা বলছেন, বেশি পরিমাণ শব্দবাজি উদ্ধার হওয়াটাই চিন্তার কারণ। ‘‘এখানেই বিপদের মস্ত ইঙ্গিত। এর থেকে আন্দাজ পাওয়া যাচ্ছে, কী বিপুল পরিমান নিষিদ্ধ বাজি বহু লোকের হাতে পৌঁছেছে।’’— মন্তব্য এক পুলিশকর্তার। যাঁর উপলব্ধি, ‘‘আগামী চার দিন শব্দ ঠেকাতে আমাদের কাঠখড় পোড়াতে হবে বিস্তর।’’

সাজার ঝাঁপি

• পশ্চিমবঙ্গে বাজির শব্দসীমা ৯০ ডেসিবেল। যার মধ্যে বড় জোর খেলনা পিস্তলের ক্যাপ ফাটানো যায়।
অর্থাৎ শব্দবাজি বলতে যা বোঝায়, তা এ রাজ্যে নিষিদ্ধ। আবার সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে
রাত দশটা থেকে সকাল ছ’টা পর্যন্ত কোনও শব্দবাজিই ফাটানো যাবে না। ৯০ ডেসিবেলের কম হলেও নয়।

নিষেধাজ্ঞা ভাঙলে

• পরিবেশ সুরক্ষা আইন

ধারা ১৫ | পাঁচ বছর পর্যন্ত জেল বা
সর্বোচ্চ ১ লক্ষ টাকা জরিমানা। কিংবা দু’টোই

• বিস্ফোরক আইন

ধারা ৯ ও ১০ | তিন বছর পর্যন্ত জেল বা
২ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা। কিংবা দু’টোই

• ভারতীয় দণ্ডবিধি

ধারা ১৮৮ (সরকারি নির্দেশ লঙ্ঘন), ২৬৮ (উপদ্রব), ২৮৫, ২৮৬
(আগুন, দাহ্যবস্তু, বিস্ফোরক নিয়ে বেপরোয়া কাজ বা গাফিলতি) |
প্রতি ক্ষেত্রে ছ’মাস পর্যন্ত জেল বা সর্বোচ্চ ১ হাজার টাকা জরিমানা। কিংবা দু’টোই

* কান ফাটানো ‘ডিজে’ সহকারে জলসা-শোভাযাত্রাও নিষিদ্ধ।
সে ক্ষেত্রে পরিবেশ-আইন ও ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৮৮ ধারা প্রযোজ্য।

লালবাজারের হিসেবে, গত বছর দিওয়ালি চুকলে দেখা গিয়েছিল, আটক নিষিদ্ধ বাজির পরিমাণ ন’হাজার কেজি। তার সিংহভাগ বাজেয়াপ্ত হয়েছিল কালীপুজো ও দিওয়ালির দুই সন্ধ্যায়। সেখানে এ বছর গত ১৫ অক্টোবর থেকে বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত মহানগরে সাড়ে আট হাজার কেজি শব্দবাজি আটক হয়েছে। গ্রেফতার ১৬ জন। এতেই পুলিশের উদ্বেগ বেড়েছে। পোড় খাওয়া অফিসারদের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, যেটুকু আটক হয়েছে, তা হিমশৈলের চূড়া মাত্র। আরও অনেক বেশি নিষিদ্ধ বাজি ইতিমধ্যে বহু লোকের হাতে চলে গিয়েছে। ‘‘আর এক বার হাতে পেলে কেউ না-ফাটিয়ে ছাড়বে না। মওকা বুঝে কোনও না কোনও একটা সময় বেছে নেবেই।’’— বলছেন লালবাজারের এক অফিসার।

এমতাবস্থায় পরীক্ষার আগের রাতে পরীক্ষার্থীর বুকের ধুকপুকুনি টের পাচ্ছে লালবাজার। যদিও তাদের দাবি, চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রস্তুতিতে কোনও খামতি রাখা হচ্ছে না। বস্তুত শব্দবাজি প্রতিরোধে কড়া হওয়ার জন্য এ বারই প্রথম খোদ পুলিশ কমিশনারের কাছ থেকে নির্দেশ গিয়েছে প্রত্যেক বিভাগীয় ডিসি’র কাছে, থানাগুলো সরসরি যাঁদের অধীনে। তাই কিছুটা কাজ হলেও হতে পারে বলে পুলিশমহল ও পরিবেশকর্মীদের আশা। সিপি’র নির্দেশের তাৎপর্য কী?

লালবাজার সূত্রের ব্যাখ্যা: কলকাতা পুলিশ এলাকায় অস্ত্র ও বিস্ফোরক সংক্রান্ত লাইসেন্স দেওয়ার প্রশাসনিক ক্ষমতা রিজার্ভ ফোর্সের ডিসি (ডিসি আরএফ)-র হাতে। সেই সুবাদে বাজির পুরো ব্যাপারটা তিনি দেখভাল করেন। যে কারণে বিভাগীয় ডিসি’দের কেউ কেউ ধরে নেন, শব্দবাজি আটক, তার ব্যবহার প্রতিরোধ ও আইনভঙ্গকারীদের পাকড়াও করার যাবতীয় দায়িত্বও মূলত ডিসি আরএফের উপরে। অতএব তাঁরা হাত গুটিয়ে থাকতেন। এক অফিসারের কথায়, ‘‘এ যাবৎ শব্দবাজির বিরুদ্ধে সিপি বিজ্ঞপ্তি জারি করলেও বিভাগীয় ডিসি’দের অনেকে তেমন তৎপর হতেন না। কিন্তু এ বার বিভাগীয় ডিসি’রা নির্দিষ্ট ভাবে সিপি’র ফরমান পেয়েছেন। তাই গা ছাড়া দেওয়ার সুযোগ কম।’’

উপরন্তু অতীতের, বিশেষত গত বছরের অভিজ্ঞতার প্রেক্ষাপটে লালবাজার বিশেষ একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। স্থির হয়েছে, শব্দবাজি নিয়ে শনিবার সন্ধ্যায় যে কড়া নজরদারি থাকবে, রবিবার তা শিথিল তো নয়ই, দরকারে আরও আঁটোসাটো করা হবে।

কেন? লালবাজার-সূত্রের বক্তব্য, গত বছর কালীপুজোর সন্ধে ও রাতের অবস্থা দেখে মনে হয়েছিল, শব্দদৈত্য বোতলবন্দি হয়েছে। কিন্তু পর দিন, অর্থাৎ দিওয়ালির সন্ধ্যায় দানব বোতল ভেঙে বেরিয়ে এসে তাণ্ডব শুরু করে দেয়। অফিসারদের অনেকে বুঝতে পারেন, আগের রাতের আত্মতুষ্টি-ই কাল হয়েছে।

শুধু তা-ই নয়। কালীপুজোর ভাসানে শব্দবাজি ও ‘ডিজে’র রমরমাও শব্দ-বিধির প্রাসঙ্গিকতাকে শিকেয় তুলেছে বলে পুলিশ ও পরিবেশকর্মীদের একাংশে আক্ষেপ প্রকট। তাঁরা বলছেন, এক সময়ে রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ নিয়মিত পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করত। শব্দদূষণ প্রতিরোধে আইনি সংস্থান সম্পর্কে পুলিশকে সচেতন করা হতো। পর্ষদের বিশেষজ্ঞদের কাছে পুলিশ রীতিমতো তালিম পেত। এখন সে সবের পাট চুকেছে বলে অভিযোগ।

বাস্তব চিত্রে এরই প্রতিফলন। সূত্রের খবর: সল্টলেকের পরিবেশ ভবনে পর্ষদের সদর দফতরের দোতলায় দু’হাজার স্কোয়্যার ফুটের ট্রেনিং হল ছিল। এ বছর বিধানসভা ভোটের তিন মাস আগে পর্ষদের এক চিফ ইঞ্জিনিয়ারের উদ্যোগে হলটি ভেঙেচুরে আধ কোটি টাকা ঢেলে পরিবেশমন্ত্রীর জন্য নতুন ঘর বানানো হয়েছে। অ্যান্টি চেম্বার ও শৌচাগার-সহ। পরিবেশ ভবনের তিনতলায় অবশ্য মন্ত্রীর নির্দিষ্ট ঘর আছে। বর্তমান পরিবেশমন্ত্রী শোভন চট্টোপাধ্যায় কোনও দিন ওই নতুন ঘরে পা রাখেননি, তিনি পুরনো ঘরেই বসেন। ‘‘নতুন ঘর এখন তালাবন্ধ। সেই সঙ্গে পর্ষদের সচেতনতা ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতেও কার্যত তালা ঝুলে গিয়েছে!’’— খেদ এক কর্তার।

তবে মন্ত্রীর কঠোর মনোভাব দেখে শনি-রবিবার শব্দদূষণ ঠেকাতে শুধু কলকাতা ও আশপাশে ডজনখানেক ‘টিম’ নামানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে পর্ষদ। বছর চারেক এটা বন্ধ ছিল। কিন্তু সোম-মঙ্গলবার কী হবে?

পর্ষদ-কর্তারা আপাতত মন্ত্রীর নির্দেশের অপেক্ষায়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement