শোকার্ত পরিবার। কাকলির (ইনসেটে) স্বামী অপূর্ব রায় (ডান দিকে)।— নিজস্ব চিত্র
ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে রক্ত নিতে হলে আগে রক্ত দিতে হবে। তবেই মিলবে রক্ত। এ হেন অলিখিত ‘নিয়ম’-এর ধাক্কাতেই প্রাণ গেল এক মহিলার।
রবিবার এই ঘটনার জেরে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে কল্যাণী জেএনএম মেডিক্যাল কলেজের চত্বর। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও অস্বস্তিতে। এমন যে কোনও নিয়ম নেই, সে কথা মানছেন ব্লাড ব্যাঙ্কের দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসকও। তবু বহাল তবিয়তেই টিকে রয়েছে এই ‘নিয়ম’।
শুক্রবার প্রসব যন্ত্রণা নিয়ে কৃষ্ণনগর সদর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন কাকলি রায় নামে বছর তিরিশের ওই মহিলা। সে দিনই পুত্রসন্তান প্রসব করেন তিনি। কিন্তু তাঁর রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়নি। শেষমেশ জানা যায়, মহিলার জরায়ুতে একটি ছোট্ট টিউমার রয়েছে। শনিবার অস্ত্রোপচার করে সেটি বাদ দেওয়া হয়। কিন্তু তার পরেও সমস্যা মেটেনি। রক্তক্ষরণের সঙ্গে দেখা দেয় আরও কিছু জটিলতা। রবিবার ভোরে তাঁকে কল্যাণী জেএনএম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রেফার করা হয়।
এ দিন সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ রোগিণী জেএনএম-এ পৌঁছন। ভর্তি করার পর চিকিৎসকরা দু’ইউনিট রক্ত আনতে বলেন। চিকিৎসকের দেওয়া রিক্যুইজিশন স্লিপ নিয়ে হাসপাতালের ব্লাড ব্যাঙ্কে যান কাকলির স্বামী অপূর্ববাবু। তিনি জানান, ব্লাড ব্যাঙ্কে তাঁকে বলা হয়, তাঁদের কাছে ‘ও’-পজিটিভ গ্রুপের রক্ত রয়েছে। কিন্তু আগে় দু’ ইউনিট রক্ত জমা না দিলে তাঁরা রক্ত দিতে পারবেন না। অপূর্ববাবু বলেন, ‘‘বারবার অনুরোধ করেও কোনও ফল হয়নি। বললাম, বাড়ি থেকে রক্ত দেওয়ার জন্য লোক আসতে দু’ঘণ্টা সময় লেগে যাবে। তত ক্ষণে বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। রক্তটা দিয়ে দিন। কিন্তু কাজ হল না।’’
ফিরে এসে অপূর্ববাবু ফের চিকিৎসকদের অনুরোধ করেন, যেন তাঁরা কাগজের উপরে ‘জরুরি’ শব্দটি লিখে দেন। চিকিৎসকরা জানান, তাঁদের দেওয়া রিক্যুইজিশন স্লিপটির অর্থই জরুরি। অপুর্ববাবু ফের ব্লাড ব্যাঙ্কে যান। ফের কাকুতিমিনতি করেন। ব্লাড ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষকে বলেন, ‘‘আমরা যদি পরে রক্ত না দিই, তা হলে না হয় স্ত্রীকে হাসপাতাল থেকে ছুটি দেবেন না।’’ প্রয়োজনে তাঁরা দাম দিয়ে রক্ত কিনতেও রাজি আছেন। কিন্তু কাজ হয়নি তাতেও।
শেষ পর্যন্ত কাকলির স্বামী কল্যাণীরই গাঁধী মেমোরিয়াল হাসপাতালের ব্লাড ব্যাঙ্কে যান। রবিবার বলে সেখানকার ব্লাড ব্যাঙ্ক বন্ধ ছিল। ফিরে হাসপাতাল চত্বরে খোঁজ করেন, কেউ যদি তাঁদের হয়ে রক্ত দেন। সেখানেই খোঁজ পেয়ে একটি ওষুধের দোকানে যান তিনি। তাঁরা জানান, বিকেলের আগে রক্ত পাওয়া যাবে না। ইতিমধ্যে খবর আসে, কাকলির অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে। এ বার হাসপাতাল থেকে কাকলির দিদি ফোন করে অপূর্ববাবুকে ডেকে নেন। হাসপাতালে ফিরে তিনি দেখেন, আরও অবনতি হয়েছে কাকলির। চিকিৎসক তাঁকে ফের রক্তের জন্য লিখে দেন। জানান, এ বার ব্লাড ব্যাঙ্কে গেলেই রক্ত পাওয়া যাবে। তখন ঘড়িতে প্রায় পৌনে বারোটা। এ বার যেতেই রক্ত মেলে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন অপূর্ববাবু।
কিন্তু ফের বেজে ওঠে ফোন। শশব্যস্ত হয়ে ফোন ধরেই তিনি বলেন, চিন্তা নেই, রক্ত মিলেছে। ওয়ার্ডে পৌঁছলেন বলে! ও পারের কণ্ঠস্বর জানান, তার আর দরকার নেই। কাকলি মারা গিয়েছেন। প্রসূতি বিভাগের চিকিৎসক সৌগত রায় জানান, রক্তাল্পতায় ভুগছিলেন কাকলি। উচ্চ রক্তচাপ-সহ কিছু জটিলতা ছিল। ওয়ার্ডে ফিরে ক্ষোভে ফেটে পড়েন কাকলির পরিবার। রক্তের বদলে রক্ত— এমন একটা অলিখিত নিয়ম প্রায় সব হাসপাতালেই চালু রয়েছে। তা নিয়ে মাঝেমধ্যেই গোলমাল বাধে। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্পষ্ট নির্দেশ, এমন নিয়ম রাখা যাবে না। এতে নিয়মের ফাঁক গলে রক্তের রমরমা ব্যবসা চালু হতে পারে। পেশাদার ডোনারদের চক্র সক্রিয় হতে পারে। কিন্তু সে নিষেধাজ্ঞাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বহাল তবিয়তে টিকে থাকা রেওয়াজই কেড়ে নিল প্রাণ। ব্লাড ব্যাঙ্কের দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসক তপন দত্ত জানান, রক্তের বদলে রক্ত দেওয়া হবে, তেমন নিয়ম নেই। কেন এমন ঘটল খোঁজ নেবেন। হাসপাতালের মেডিক্যাল সুপার স্নেহপ্রিয় চৌধুরীও বলেন, ‘‘বিষয়টি জানি। প্রাথমিক কথাবার্তা বলেছি। তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’ কাকলির বাড়ির লোকেরা জানিয়েছেন, সোমবার তাঁরা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ জানাবেন।