হৃদয় বণিক। নিজস্ব চিত্র
চেয়েচিন্তে টাকা জোগাড় করে কিশোর ছেলের জন্য এয়ার অ্যাম্বুল্যান্সের ভাড়া মিটিয়েছিলেন বাবা। পাইলট অসুস্থ হয়ে পড়ায় ছাড়লই না সেই এয়ার অ্যাম্বুল্যান্স। তাতে গুরুতর অসুস্থ ছেলেকে কলকাতা থেকে দিল্লি নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল ত্রিপুরার দুলাল বণিকের। তাঁর অভিযোগ, ছেলে হৃদয়কে নিয়ে কলকাতা বিমানবন্দরে এয়ার সাইডে ঘণ্টা দুয়েক অপেক্ষা করেন তিনি। সেখানেই মারা যায় ১৭ বছরের হৃদয়।
শুক্রবার দুলালবাবু কাঁদতে কাঁদতে ত্রিপুরার সিপাহিজলা থেকে ফোনে বলেন, ‘‘ওই গরমে বিমানবন্দরে খোলা আকাশের নীচে অ্যাম্বুল্যান্সের ভিতরে আমার চোখের সামনে ছেলেটা চলে গেল।’’ মঙ্গলবার বিমানবন্দর থেকে ইএম বাইপাসের কাছে একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরে হৃদয়কে মৃত ঘোষণা করেন সেখানকার চিকিৎসক।
ময়না-তদন্তের পরে বৃহস্পতিবার হৃদয়ের দেহ আগরতলায় নিয়ে যাওয়া হয়। দুলালবাবু ছোটখাটো ব্যবসা করেন। তাঁর আক্ষেপ, ‘‘কোনও ভাবে বন্ধুদের কাছ থেকে জোগাড় করে সোমবার রাতে এয়ার অ্যাম্বুল্যান্সের জন্য সাড়ে ন’লক্ষ টাকা দিয়েছিলাম। সকাল থেকে বেশ কয়েক বার সময় পরিবর্তন করে শেষে বেলা ১১টা নাগাদ কলকাতা বিমানবন্দরে পৌঁছতে বলা হয় আমাদের। বিমানবন্দরে পৌঁছনোর পরেও বারবার আশ্বাস দেওয়া হয়, এ বার ছাড়বে। কিন্তু অপেক্ষা করতে করতেই সব শেষ হয়ে গেল। ছেলেটার চিকিৎসার শেষ সুযোগটুকুও পেলাম না।’’
বিমানবন্দরের খবর, দুই পাইলট মঙ্গলবার বেলা ১১টায় বিমান নিয়ে কলকাতায় নামেন। কিন্তু নামার পরেই সহকারী পাইলট গগনজিৎ সিংহ নারোয়াল আচমকা অসুস্থ হয়ে পড়েন। সংশ্লিষ্ট সূত্রের খবর, সেই অসুস্থতা মূলত মানসিক। তিনি কোনও কারণ ছাড়াই রেগেমেগে বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে যান। ফলে বিমান ছাড়া যায়নি। ভুবনেশ্বর থেকে উড়ান সংস্থার অন্য পাইলটকে কলকাতায় উড়িয়ে আনা হয় বিকেলে। তত ক্ষণে সব শেষ। বিমানবন্দর সূত্রে জানা গিয়েছে, সে-দিন সন্ধ্যায় নিজে টিকিট কেটে সাধারণ বিমানে দিল্লি ফেরার সময় বিমানবন্দরের রক্ষীদের সঙ্গেও বচসায় জড়িয়ে পড়েন গগন। বিমানবন্দর থানার পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। রাতেই এক বন্ধু এসে জামিন করিয়ে তাঁকে নিয়ে যান।
দুলালবাবুর পরিবার সূত্রের খবর, এ বছরেই হৃদয়ের দশম শ্রেণির ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। মা বকাবকি করায় ২২ মে সে ইঁদুর মারার বিষ খায়। রাতে বমি হওয়ায় তাকে আগরতলার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সুস্থ হয়ে বাড়িও ফিরে যায় হৃদয়। সামনেই ফাইনাল পরীক্ষা। তাই দুলালবাবু কলকাতায় এক বার ছেলের চিকিৎসা করাতে চেয়েছিলেন। ভাই সুভাষ এবং ছেলেকে নিয়ে ২৫ মে কলকাতায় আসেন তিনি। ২৬ মে বাইপাসের ধারে একটি হাসপাতালে হৃদয়ের শারীরিক পরীক্ষার পরে সন্ধ্যায় হোটেলে ফিরে যান।
সেই রাতেই অসুস্থ হয়ে পড়ে হৃদয়। ২৭ তারিখে ওই হাসপাতালে ভর্তি করানোর পরে চিকিৎসকেরা অবিলম্বে দিল্লি নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। আগরতলায় দুলালবাবুর আত্মীয়বন্ধুরা যোগাযোগ করেন সেখানকার বিমানবন্দরে কর্মরত পরীক্ষিৎ দে-র সঙ্গে। তিনি নিয়ে ট্রাভেল এজেন্সি চালান। তিনি সাড়ে ন’লক্ষ টাকার বিনিময়ে এয়ার অ্যাম্বুল্যান্স জোগাড় করে দেওয়ার আশ্বাস দেন। ঠিক হয়, দিল্লি থেকে এয়ার অ্যাম্বুল্যান্স (ছোট বিমান) এসে হৃদয়কে নিয়ে যাবে। অভিযোগ, সেই রাত থেকে পরের দিন সকাল পর্যন্ত প্রায় চার বার এয়ার অ্যাম্বুল্যান্স কলকাতায় আসার সময় বদল করে। শেষে বেলা ১১টায় কলকাতায় এসে নামে সেই এয়ার অ্যাম্বুল্যান্স।
ছেলেকে নিয়ে দুলালবাবু একই সময়ে পৌঁছে যান বিমানবন্দরে। তাঁর ভাই সাধারণ বিমানে দিল্লি রওনা হন। কলকাতা বিমানবন্দরে হাসপাতালের বড় অ্যাম্বুল্যান্স থেকে নামিয়ে বিমানবন্দরের ছোট অ্যাম্বুল্যান্সে তুলে হৃদয়কে নিয়ে যাওয়া হয় এয়ার সাইডে। তাঁদের নামে বোর্ডিং কার্ডও তৈরি হয়। অ্যাম্বুল্যান্সে চিকিৎসক ছিলেন। ঘণ্টা দুয়েক অপেক্ষা করার পরে সেই চিকিৎসকই জানান, হৃদয়ের অবস্থার অবনতি হচ্ছে। অচেতন হৃদয়ের জ্ঞান আর ফেরেনি।