পিংলার সেই স্কুল। নিজস্ব চিত্র।
বয়স সবে এক বছর পেরিয়েছে। পশ্চিম মেদিনীপুরে পিংলার প্রত্যন্ত গ্রামের সেই স্কুলই এখন চর্চার কেন্দ্রে।
ঝাঁ-চকচকে ‘বিসিএম ইন্টারন্যাশনাল স্কুল’ গড়ে উঠেছে ‘বাবলি চট্টোপাধ্যায় মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন’-এর সৌজন্যে। বাবলি রাজ্যের মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের প্রয়াত স্ত্রী। প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীর স্ত্রীর নামেই পিংলার খিরিন্দা মৌজায় সাড়ে তিন একর জমিতে ওই ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের নামকরণ হয়েছে। আর এই স্কুল করেছেন পার্থের জামাই কল্যাণময় ভট্টাচার্য, তাঁর মামার থেকে জমি লিজ়ে নিয়ে। গত বছর এপ্রিলে স্কুল চালুর পরে চলতি বছরে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে দু’বার এসেছিলেন পার্থ নিজেও। মন্ত্রী সিবিআইয়ের জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়ার পর রাতারাতি চর্চায় চলে এসেছে এই স্কুল।
কারণ, এই স্কুলের বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যে সরব হয়েছেন বিরোধীরা। বিজেপি বিধায়ক শুভেন্দু অধিকারী টুইট করেছেন ওই স্কুল তৈরি সম্পর্কে কিছু তথ্য দিয়ে। সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী সাংবাদিক বৈঠকে প্রশ্ন তুলেছেন, ‘‘প্রত্যন্ত গ্রামে এত টাকা দিয়ে যে স্কুল হল, তার উৎসটা কী?’’ এতে কি আপনার বিনিয়োগ আছে? হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজে পার্থের জবাব, ‘‘সর্বৈব মিথ্যা কথা।’’ পিংলার বিধায়ক তথা জেলা তৃণমূলের চেয়ারম্যান অজিত মাইতিরও বক্তব্য, ‘‘ওখানে পার্থদা স্কুল করেছেন বলে জানা নেই। কারও জামাই যদি শাশুড়ির নামে স্কুল করেন, সেটা অন্যায় নয়। আর জামাইয়ের স্কুল মানেই সেখানে শ্বশুরের টাকা থাকবে এমনটাও নয়।’’
তবে স্কুল ঘিরে বিরোধীদের এত চর্চায় শঙ্কিত অভিভাবকেরা। বেসরকারি স্কুলটিতে সিবিআই হানারও আশঙ্কা করছেন তাঁরা। সঙ্গে চিন্তা খুদে পড়ুয়াদের ভবিষ্যৎ নিয়ে।
যাঁর জমিতে এই মস্ত স্কুল মাথা তুলেছে, মন্ত্রীর জামাইয়ের সেই মামা কৃষ্ণচন্দ্র অধিকারীর বছর চারেক আগে পেশা ছিল যজমানি। পরে তিনিই হলেন বিপুল জমির মালিক, ‘উদ্যোগপতি’। তাঁর ‘অ্যাগ্রোটেক’ সংস্থার জমিতেই তৈরি হল স্কুল। তিনি অবশ্য সিবিআই তদন্তের মুখোমুখি হতে প্রস্তুত। কৃষ্ণচন্দ্রের দাবি, “বোটানিক্স অ্যাগ্রোটেক গড়ার জন্য ২০১৮ সাল থেকে ধাপে-ধাপে জমি কিনেছি। পরে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের জামাই, আমার ভাগ্নে কল্যাণময় ভট্টাচার্য ৭ বিঘা জমি লিজ়ে নিয়ে এই স্কুল গড়েছে। শাশুড়ির নামে ও কেন স্কুলের নাম দিয়েছে তা অবশ্য আমার জানা নেই।’’ তিনি এ-ও বলেন, ‘‘ভাগ্নে সস্ত্রীক বিদেশে থাকে। আমিই স্কুলের কাজকর্ম দেখভাল করি। সিবিআই তদন্তে এলে জবাব দিতে তৈরি আছি।” এই বিষয়ে জানতে কল্যাণময়কে ই-মেল করা হয়েছিল। তবে কোনও জবাব মেলেনি।
গ্রামের সাধারণ পুরোহিত কৃষ্ণচন্দ্রের উদ্যোগপতি হয়ে ওঠা অবশ্য খুব সোজা ঠেকেনি গ্রামবাসীদের। স্থানীয় এক বাসিন্দার দাবি, “কৃষ্ণচন্দ্র অধিকারীরা আগে যজমানি করতেন। ভাগ্নের কল্যাণে এখন ওঁরা খুব প্রভাবশালী। বিশাল গাড়িতে ঘুরে বেড়ান। সম্পত্তি করেছেন। স্কুলের তো সবটাই কৃষ্ণদা।” আর কৃষ্ণচন্দ্রের দাবি, “বিশ বচ্ছর ধরে পৈতৃক জমি বেচে তিল তিল করে গড়া ধানের ব্যবসায় উন্নতি করেছি। আর গাড়ি তো স্কুলের।”
স্কুলের অধ্যক্ষ দেবযানী মিত্র শুধু বলেন, “স্কুল নিশ্চয় মন্ত্রীর স্ত্রীর নামে। তবে এ সব বিষয়ের সঙ্গে পড়াশোনাকে মেশাতে চাইছি না। আর আমরাও যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিযুক্ত হয়েছি।’’
তবে অভিভাবকরা উদ্বিগ্ন। জামনার বাসিন্দা নির্মাল্য হাজারির মেয়ে এই স্কুলে পড়েন। তিনি বলেন, “প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীর স্ত্রীর নামে ওই স্কুল হওয়ায় ভাল পড়াশোনা হবে আশা করেই মেয়েকে ভর্তি করেছি। কিন্তু এখন যা হচ্ছে, তাতে সিবিআই এলে আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ কী হবে!” ওই স্কুলেই নাতিকে ভর্তি করালেও তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যাওয়া জেলা নেতা অমূল্য মাইতি বলছেন, “জামাই কী এমন করেন যে ৫০ কোটি টাকা খরচ করেস্কুল করবেন?”
স্থানীয় সূত্রে খবর, নোটবন্দির পর থেকেই নগদে জমি কেনা শুরু হয়েছিল। এক জমিদাতা, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক কৃষ্ণচন্দ্র রাউত বলেন, “আমার ৭৩ ডেসিমেল জমি বোটানিক্স অ্যাগ্রোটেকের নামে কৃষ্ণচন্দ্র অধিকারীকে বিক্রি করেছিলাম প্রায় ১১ লক্ষ টাকায়। নগদেই টাকা দেওয়া হয়েছিল।” যদিও কৃষ্ণচন্দ্র অধিকারী দাবি করেন, “জমির যাবতীয় টাকা চেকেই দেওয়া হয়েছিল।”
(এই প্রতিবেদনটি প্রথম প্রকাশের সময় লেখা হয়েছিল, স্কুল তৈরির জন্য কল্যাণময় ভট্টাচার্য জমি লিজ নিয়েছেন তাঁর শ্বশুর পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কাছ থেকে। আসলে তিনি জমিটি লিজ নিয়েছিলেন তাঁর মামার কাছ থেকে।অনিচ্ছাকৃত এই ত্রুটির জন্য আমরা আন্তরিক দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী।)