শুভেন্দু অধিকারী। —ফাইল চিত্র।
কয়েক মাস আগে এগরায় বিস্ফোরণ এবং প্রাণহানির পরে এই ধরনের ঘটনা রুখতে পুলিশ-প্রশাসনের কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এর পরে আবার উত্তর ২৪ পরগনার দত্তপুকুরে বাজি কারখানায় বিস্ফোরণে অন্তত ৭ জনের মৃত্যুর পরে রাজ্য প্রশাসনের ‘ব্যর্থতা’র অভিযোগে সরব হল বিরোধীরা। দাবি উঠল এনআইএ তদন্তেরও। শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস অবশ্য বিরোধীদের দাবি নস্যাৎ করে পাল্টা বলেছে, পুলিশই তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেবে।
যেখানে রবিবার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে, সেই মোচপুল পশ্চিমপাড়া এলাকা দত্তপুকুর থানা এবং মধ্যমগ্রাম বিধানসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত। তৃণমূলের দাবি, স্থানীয় আইএসএফ কর্মী বাজি কারখানার সঙ্গে জড়িত। আইএসএফের পাল্টা দাবি, তৃণমূল ও পুলিশের সাহায্যে বাজি কারখানা চলছিল। স্থানীয় বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী রথীন ঘোষ আবার দাবি করেছেন, ওই এলাকায় বাজি কারখানার কথা তাঁর জানাই ছিল না। ঘটনা ঘিরে এই চাপান-উতোরের মধ্যেই রাতে ঘটনাস্থলে পৌঁছন রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোস। সকালে রাজ্যপাল ছিলেন শিলিগুড়িতে, সেখান থেকে ফিরেই সোজা গিয়েছিলেন প্রথমে দত্তপুকুরে এবং পরে বারাসতের হাসপাতালে আহতদের দেখতে। অভিঘাতের নিরিখে ‘বড় ঘটনা’ আখ্যা দিয়ে রাজ্যপালের মন্তব্য, ‘‘এই দুর্ঘটনা নিছক ঘটনাচক্রে ঘটেনি। তদন্ত হচ্ছে, পুলিশ দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।’’ তিনিও কেন্দ্রীয় সংস্থাকে দিয়ে তদন্ত করানোর পক্ষপাতী কি না, সেই প্রশ্নে রাজ্যপাল বোস অবশ্য বলেছেন, ‘‘এখনই এই নিয়ে মন্তব্য করার সময় নয়। ধৈর্য ধরতে হবে।’’
প্রধান বিরোধী দল বিজেপি অবশ্য এনআইএ তদন্ত দাবি করেছে। ওই দাবি জানিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে চিঠি দিয়েছেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। চিঠিতে তাঁর অভিযোগ, ঘটনার পিছনে জঙ্গি কার্যকলাপ থাকতে পারে। সুকান্তের বক্তব্য, ‘‘গোটা রাজ্যটাকে বারুদের স্তূপের উপরে রেখে দিয়েছে এই সরকার! এই মৃত্যুর জন্য দায়ী মুখ্যমন্ত্রী। মিজ়োরামে বাংলার শ্রমিক মারা যাচ্ছেন, পঞ্চায়েত নির্বাচনে মানুষ মারা গিয়েছেন, বিস্ফোরণে মানুষ মারা যাচ্ছেন, ডেঙ্গিতে মানুষ মারা যাচ্ছেন। মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যটাকে কি শ্মশান বানাতে চাইছেন?’’ তাঁর অভিযোগ, ‘‘পুরোপুরি বেআইনি কারখানা। তৃণমূল তোলা তোলে এই ধরনের কারখানা থেকে। খোঁজ নিয়ে দেখুন, কোনও না কোনও নেতা হপ্তা তুলত!’’ এনআইএ তদন্তের দাবি করেছেন কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী শান্তনু ঠাকুরও। দত্তপুকুরে গিয়ে একই দাবি তুলেছেন আইএসএফের বিধায়ক নওসাদ সিদ্দিকী ও কংগ্রেস নেতা কৌস্তভ বাগচীও।
বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর বক্তব্য, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী বড় বড় কথা বলেছিলেন। মুখ্যসচিবের নেতৃত্বে কমিটি গঠন হবে। বেআইনি বাজি কারখানার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে। তা হলে এগুলো হল কী করে? আসলে মুখ্যমন্ত্রীর প্রশাসন চালানোর দিকে মন নেই। পুলিশ ব্যস্ত ‘লিপ্স অ্যান্ড বাউন্ডস-এর চোরদের বাঁচানোর জন্য আর বিরোধীদের উপরে মিথ্যা মামলা দেওয়ার জন্য। তাই জন্য এই অবস্থা।’’
মালদহে গিয়ে রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম পাল্টা বলেছেন, ‘‘পুলিশ ঘটনার তদন্ত করছে। দোষীর শাস্তি হবে। মেদিনীপুরে যেমন হয়েছিল। গ্রেফতার হয়েছে। উত্তরপ্রদেশের মতো এনকাউন্টারে আমরা মারব না! আদালতের মতে শাস্তি হবে।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী বার বার করে বলছেন, ‘বাজি হাব’ তৈরি করার কথা। তার পরেও যারা এ সব করছে, অন্যায় করছে।’’ দত্তপুকুরে গিয়ে সন্ধ্যায় তৃণমূল সাংসদ কাকলি ঘোষ দস্তিদারও এনআইএ তদন্তের দাবি প্রসঙ্গে পাল্টা মন্তব্য করেছেন, ‘‘এফবিআই আসুক, এনআইএ আসুক, ওঁরা চাইতেই পারেন! আমরা মনে করি, এই ঘটনার তদন্ত করতে রাজ্যের পুলিশ-প্রশাসন যথেষ্ট।’’ তাঁরও বক্তব্য, যাঁরা বাড়িতে বাজির কারবার করছেন, তাঁরা নিজেদের ‘দায়িত্বে’ করছেন।
স্থানীয় বিধায়ক তথা রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী রথীনের দাবি, তিনি জানতেনই না, ওখানে বাজি কারখানা চলছে। তাঁর দাবি, ‘‘বিস্ফোরণের পরে ঘটনা শুনলাম স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্যের কাছে। শুনেছি, আইএসএফ কর্মী রমজান আলির বাড়িতে থাকতেন বাজি তৈরির শ্রমিকেরা। ওরাই জড়িত বাজির বেআইনি কারবারে। আমি আগে জানলে পুলিশকে পদক্ষেপ করতে বলতাম।’’ সংবাদমাধ্যমে মন্ত্রীর মন্তব্য জানাজানি হতেই ক্ষোভে ফেটে পড়েন স্থানীয় বহু মানুষ। তাঁদের দাবি, সকলেই সব জানত। পুলিশ এলাকায় এসে বেআইনি বাজি কারবারিদের কাছ থেকে ‘মাসোহারা’ নিত। পুলিশ অবশ্য অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে। সন্ধ্যায় ঘটনাস্থলে আসেন সাংসদ কাকলি, মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। আসেন আইএসএফ বিধায়ক নওসাদও। কথা বলেন স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে। রথীনের পাল্টা নওসাদ পরে বলেন, ‘‘আমি এনআইএ তদন্তের দাবি করছি। আইএসএফের কেউ জড়িত থাকলে আমি নিজে পুলিশকে বলব, কড়া ব্যবস্থা নিতে! তৃণমূলের নেতারা এই কারখানার মাসোহারা নিতেন পুলিশের মাধ্যমে, তার ভাগ হয়তো মন্ত্রীর কাছেও যেত! এনআইএ তদন্ত হলে অনেক কিছুই প্রকাশ্যে আসবে।’’
প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর বক্তব্য, ‘‘ভেবেছিলাম রাজ্য সরকার শিক্ষা নেবে। বিধি-নিষেধ আরোপ করবে। মানুষের মৃত্যু ঠেকানো যাবে। কিন্তু এই সরকার শুধুমাত্র ব্যর্থতার দলিল লিখছে! মানুষের জীবন বড় সস্তার হয়ে যাচ্ছে বাংলায়।’’ প্রদেশ সভাপতির নির্দেশে উত্তর ২৪ পরগনা জেলা (গ্রামীণ) সভাপতি অমিত মজুমদার, অশোক ভট্টাচার্য, সালাউদ্দিন ঘরামিদের নিয়ে একটি প্রতিনিধিদল ঘটনাস্থল ঘুরে হাই কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত কোনও বিচারপতির নেতৃত্বে বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি করেছে। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী এ দিনই জলপাইগুড়িতে বলেছেন, ‘‘এগরা, মালদহ, বজবজ, দত্তপুকুর— হয়েই চলেছে। মুখ্যমন্ত্রীর কথার কি কোনও গুরুত্ব নেই? পুলিশ কি তাঁর কথা শুনছে না? পঞ্চায়েত ভোটের জন্য যে সব মশলা মজুত করা হয়েছিল, তার পরিণতি এখন টের পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাকে বারুদের স্তূপের উপরে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর দল!’’ মৃতদের জন্য ক্ষতিপূরণের দাবি করে এসইউসি-র রাজ্য সম্পাদক চণ্ডীদাস ভট্টাচার্যের বক্তব্য, এগরার খাদিশোলের ঘটনার পুনরাবৃত্তি আটকানোর কথা বলার পরেও দত্তপুকুরের ঘটনা ‘রাজ্য সরকারের অপরাধমূলক নিষ্ক্রিয়তারই প্রমাণ’।