শাসকদলের বিরুদ্ধে ক্ষোভে শুক্রবার বাঁকুড়ার তামলিবাঁধে জোটের নেতা-কর্মীদের জমায়েত।—নিজস্ব চিত্র
কবেই ভোট পর্ব চুকেবুকে গিয়েছে। রাজ্যে বিপুল ক্ষমতা নিয়ে ফের ক্ষমতায় ফিরে এসেছে তৃণমূল। অথচ ভোট পরবর্তী সন্ত্রাসের ঘটনা থামছেই না বাঁকুড়ায়! বিরোধীদের দলের কর্মী থেকে বিধায়কদের উপর হামলার অভিযোগে জেলার বিভিন্ন এলাকার তৃণমূল কর্মীরা জড়িয়ে পড়ছেন। কিন্তু হামলার ঘটনায় লাগাম পড়ছে না। আর এই প্রসঙ্গেই হামলায় রাশ টানতে শাসকদলের জেলা নেতাদের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ধরপাকড়ের সংখ্যাও খুবই নগন্য হওয়ায় পুলিশের ভূমিকাও প্রশ্নের মুখে। শুক্রবার বাঁকুড়ার তামলিবাঁধে জোটের নেতারা জমায়েত করে এমনই সব অভিযোগ তুললেন। পরে জেলাশাসককে তাঁরা স্মারকলিপিও দেন।
বিধানসভা ভোট গণনা শেষ হওয়ার পরেই মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘অশান্তি করা চলবে না’ বলে দলের কর্মীদের বার্তা দিয়েছিলেন। বাঁকুড়াতেও কর্মীদের ‘সংযত’ থাকতে নির্দেশ দিয়েছিলেন তৃণমূলের জেলা নেতারা। তারপরেও বিরোধীদের উপর বারবার আক্রমণের ঘটনা চলতে থাকায় শীর্ষ নেতৃত্বের হাতে দলের রাশ কতটা আছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। বিরোধীরাও দুষতে ছাড়ছে না প্রশাসনকেও।
ঘটনা হল দক্ষিণবঙ্গের মধ্যে বাঁকুড়া জেলায় তুলনামূলক ভাবে ভাল ফল করেছে বিরোধী জোট পক্ষ। জেলার ১২টি আসনের মধ্যে পাঁচটি আসনেই জয় পেয়েছে বিরোধী জোট। যার মধ্যে বাঁকুড়া ও বিষ্ণুপুরের আসনে কংগ্রেস প্রার্থী, সোনামুখী ও বড়জোড়ায় সিপিএম এবং ছাতনায় আরএসপি প্রার্থী জয়লাভ করেছেন। ভোটের ফল প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই বড়জোড়া, বিষ্ণুপুর ও ওন্দা কেন্দ্রে লাগাতার বিরোধীদের উপর হামলার অভিযোগ উঠেছে শাসকদল তৃণমূলের বিরুদ্ধে।
বিষ্ণুপুরের কংগ্রেস বিধায়ক তুষারকান্তি ভট্টাচার্যের উপর কয়েকদিন আগে তালড্যাংরার আমড্যাংরা এলাকায় হামলার অভিযোগ ওঠে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। তাঁর গাড়ি ভাঙচুর করা। হামলাকারীদের হাত থেকে কোনও ভাবে বেরিয়ে আমড্যাংরা পুলিশ ফাঁড়িতে অভিযোগ জানাতে গেলে সেখানেও দুষ্কৃতীরা গিয়ে থানা ঘেরাও করে রাখে বলে অভিযোগ। রাতে পুলিশ বাহিনী গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
এই ঘটনার দু’দিন পরেই বড়জোড়ার বিধায়ক সিপিএমের সুজিত চক্রবর্তীর গাড়ি ঘেরাও করে ভাঙচুর চালানোর অভিযোগ ওঠে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। ঘটনার সময় সুজিতবাবু ওই গাড়িতেই ছিলেন। দু’টি ঘটনাতেই প্রতিবাদে নামে বিরোধীরা। বিষ্ণুপুরে একদিনের বন্ধ ডাকা হয়। বড়জোড়াতেও বাঁকুড়া-দুর্গাপুর রাজ্য সড়কে পথ অবরোধে নেমেছিলেন সিপিএম কর্মীরা। ওন্দা বিধানসভার বিভিন্ন গ্রামে তৃণমূলের বিজয় মিছিল থেকে হামলা চলে বামফ্রন্ট কর্মীদের বাড়িতে।
লাগাতার হামলার ঘটনার পরেও পুলিশ ও প্রশাসন এ সব রুখতে সে ভাবে পদক্ষেপ করেনি বলে অভিযোগ তুলছেন বিরোধীরা নেতারা। সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য সুজয় চৌধুরী বলেন, “গণনার দিন থেকে বড়জোড়া কেন্দ্রে হামলার ঘটনা শুরু হয়েছে। কোথাও কর্মীদের বাড়িতে ঢুলে হামলা, কোথাও প্রকাশ্য রাস্তায় হামলা। পুলিশ দু’একটি ক্ষেত্রে কিছু তৃণমূল কর্মীকে গ্রেফতার করেছে। এর বেশি আর কিছুই করা হয়নি। এতেই তৃণমূলের লোকেরা হামলা চালাতে উৎসাহ পাচ্ছে।” বিষ্ণুপুরের বিধায়ক তুষারকান্তিবাবু বলেন, “সন্ত্রাস এড়াতে পুলিশ জোট কর্মীদের ঘরে বসে থাকতে বলছে। এটা কী কোনও সমাধান হল?’’
এ দিকে কোথাও কোনও ঝামেলার হলেই পাল্টা অভিযোগ করছে শাসকদল তৃণমূলও। যেমন তৃণমূলের বড়জোড়া ব্লক সভাপতি জহর বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাল্টা অভিযোগ, “ভোটে সিপিএম জয়লাভ করার পর থেকেই বিভিন্ন অঞ্চলে আমাদের কর্মীদের নানা ভাবে টিপ্পনি কেটে, হুমকি দিয়ে এমনকী কোথাও কোথাও মারধরও করে ঝামেলা পাকাচ্ছে। গায়ে পড়ে ওরা ঝগড়া লাগাচ্ছে।’’ তবে একই সঙ্গে তাঁর দাবি, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মিথ্যা অভিযোগ তুলে তৃণমূল কর্মীদের জেলে ভরার চেষ্টা করছে বিরোধীরা।
শাসক-বিরোধী ঝামেলার প্রভাব পড়ছে সাধারণ জনজীবনেও। সোমবার রাতেই গঙ্গাজলঘাটির নবগ্রামে একটি গাজন উৎসবে গ্রামের দু’টি পাড়ার ঘটনা বৃহত্তর আকার নেয় রাজনৈতিক রং ছড়িয়ে যাওয়ায়।
এই পরিস্থিতিতে প্রশাসন অশান্তি রুখতে কড়া পদক্ষেপ করুক, চাইছেন সাধারণ মানুষও। কী করছে প্রশাসন? বাঁকুড়ার জেলাশাসক মৌমিতা গোদারা বসু বলেন, “ভোট গণনার কয়েক দিন আগেই আমরা এলাকায় শান্তি বজায় রাখতে সর্বদল বৈঠক করেছিলাম। যে সব এলাকায় অশান্তি হচ্ছে সেখানে পুলিশ ব্যবস্থা নিচ্ছে। মহকুমা শাসকেরাও নজর রাখছেন পরিস্থিতির উপর।”
জেলা পুলিশ সুপার নীলকান্ত সুধীর কুমার বলেন, “গণনার আগে রাজনৈতিক দলগুলি বলেছিল বিজয় মিছিল হবে শুধু ব্লক স্তরে। কিন্তু এখন অঞ্চল স্তরেও বিজয় মিছিল হচ্ছে। আমরা পুলিশি পাহারায় সেই মিছিল করাচ্ছি। রাজনৈতিক হামলার ঘটনা ঘটলে পুলিশ কড়া ব্যবস্থাও নিচ্ছে।”
যদিও বিরোধীরা অবশ্য পুলিশ ও প্রশাসনের ভূমিকায় সন্তুষ্ট নয়। হামলা রুখতে প্রশাসন যাতে সক্রিয় হয়, সেই দাবিতে আজ শুক্রবার জোটের তরফে বাঁকুড়ার তামলিবাঁধ এলাকায় অবস্থান বিক্ষোভ কর্মসূচি নেওয়া হয়। এখন দেখার এরপরে হামলায় ছেদ পড়ে কি না।