নোট-বিতর্কের হাত ধরে রাজ্য রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন ঘটল সারদা-প্রশ্নের! প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বেঁধে দেওয়া ৭২ ঘণ্টার সময়সীমা যখন ফুরোচ্ছে, সেই সময়েই কলকাতায় পথে নেমে সারদা-সহ বেসরকারি অর্থলগ্নি সংস্থার হাতে প্রতারিত মানুষের টাকা ফেরতের দাবিতে ফের সরব হলেন সিপিএম ও কংগ্রেস নেতারা। হাইকোর্টের গড়ে দেওয়া কমিটির সঙ্গে মমতার সরকার কেন সহযোগিতা করছে না, সেই প্রশ্ন তুলে রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠীরও দ্বারস্থ হলেন সূর্যকান্ত মিশ্র, আব্দুল মান্নান, সুজন চক্রবর্তী, বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যেরা।
প্রধানমন্ত্রীর ৫০০ ও হাজার টাকার নোট বাতিল সিদ্ধান্ত পুরোপুরি প্রত্যাহারের দাবিতে তৃণমূল নেত্রী যে ভাবে সরব হয়েছেন, তাতে জনমানসের একাংশে প্রশ্ন উঠেছে— সারদা, নারদার মতো কেলেঙ্কারিতে যে হেতু শাসক দলের লোকজনের জড়িত থাকার অভিযোগ ছিল, তা হলে কি সেই সূত্রেই বিপদে পড়ে নিজেদের পিঠ বাঁচাতে মরিয়ে হয়ে উঠেছে তৃণমূল? বিরোধী কংগ্রেস ও বাম নেতারা সেই ধারণাকেই আরও উস্কে দিতে চেয়ে সারদা-সহ লগ্নি সংস্থার প্রসঙ্গ ফের সামনে আনছেন। তাঁদের প্রশ্ন, সাধারণ ও গরিব মানুষের সমস্যায় মুখ্যমন্ত্রী এতই উদ্বিগ্ন হলে লগ্নি সংস্থায় ক্ষতিগ্রস্তদের টাকা ফেরাতে হাইকোর্টের কমিটির সঙ্গে অসহযোগিতা করছেন কেন? আর মমতার অতি-সক্রিয়তাকে বিঁধে রাজ্য বিজেপি-র সভাপতি দিলীপ ঘোষ সরাসরিই দাবি করেছেন, কালীঘাটের বাড়িতেই আগে তল্লাশি হওয়া উচিত!
তৃণমূল নেত্রীর হইচইয়ের মুখে স্বয়ং মোদীই রবিবার ‘চিট ফান্ড’ প্রসঙ্গ টেনে এনে পাল্টা আক্রমণে গিয়েছিলেন। মমতা সোমবার নবান্নে বসে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে পাল্টা বলেছেন, ‘‘আরবিআই, সেবি সব তোমার হাতে। এত দিন কেন কোনও ব্যবস্থা নাওনি? কেন এত দিন চুপ করে বসেছিলে?’’ তবে তাঁর সাংবাদিক সম্মেলন শুনে বিজেপি-র এক নেতার প্রতিক্রিয়া, ‘‘প্রধানমন্ত্রীর খোঁচার পরে মুখ্যমন্ত্রীর মুখে আর বারাণসীর কথা নেই! এখন উনি বিহার-পঞ্জাব যাবেন!’’
বিরোধীদের পাল্টা চাপে রাখতে মমতা এ দিন ফের দাবি করেছেন, বাম আমলেই রাজ্যে অর্থলগ্নি সংস্থার বাড়বাড়ন্ত ও যাবতীয় দুর্নীতি হয়েছে। তাঁর বক্তব্য, ‘‘আমরা আসার পরেই চিট ফান্ডের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’’ অর্থলগ্নি সংস্থার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিতে ফের কংগ্রেস-সিপিএম একসঙ্গে পথে নামায় তাদের আক্রমণ করে মমতার মন্তব্য, ‘‘কেউ যদি বিজেপি-কে মদত দিতে এ সব করে, করুক! আজ পর্যন্ত সিপিএমের কোনও নেতা গ্রেফতার হয়েছে? দোষ না করেও আমাদের লোকেরা গ্রেফতার হয়েছে। এ সবই আসলে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা!’’
বিরোধীরা আবার পত্রপাঠ জবাব ফিরিয়েও দিয়েছে! বিরোধী দলনেতা মান্নান যেমন বলেছেন, ‘‘৭২ ঘণ্টা হয়ে গেল। তর্জন-গর্জনই সার! আসলে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন চিট ফান্ডের কোটি কোটি টাকা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে! সেই শোক ভুলতে না পেরে দিশাহারা হয়ে যাচ্ছেন।’’ রাজভবন থেকে বেরিয়ে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যবাবুও বলেছেন, ‘‘উনি আর মোদী বোঝাপড়া করেই চলছেন। নিজেদের কেলেঙ্কারি বাঁচাতে উনি কেন্দ্রের উপরে চাপ দেওয়ার কথা বলছেন। আর প্রধানমন্ত্রী শুধু মুখে বলছেন, কাজে কিছু নেই এত দিনেও!’’
কলকাতা হাইকোর্ট লগ্নি সংস্থার টাকা ফেরাতে এস পি তালুকদার কমিটি গড়ে দেওয়ার পরেও তার বিরুদ্ধে ই়ডি কেন সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানাতে গিয়েছিল, সেই প্রসঙ্গ টেনে কেন্দ্রের ‘সদিচ্ছা’ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সূর্যবাবু। লগ্নি সংস্থার আমানতকারী ও এজেন্ট সুরক্ষা মঞ্চের তরফে এ দিন কলেজ স্কোয়ার থেকে মিছিল করে এসে রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ে সমাবেশের পরে রাজ্যপালের কাছে গিয়েছিলেন সূর্যবাবু, মান্নান, সুজনবাবু, বিকাশবাবু, অশোক গঙ্গোপাধ্যায়, আইনজীবী শুভাশিস চক্রবর্তী, অরিন্দম দাসেরা। তার আগে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের দফতরের সামনে নোট-কাণ্ডে বামেদের বিক্ষোভও হয়েছে।
বাম-কংগ্রেসের থেকে পৃথক থাকলেও বিজেপি জানিয়েছে, মমতার প্রচারের পাল্টা হিসাবে নোট বাতিলের সমর্থনে যুক্তি বোঝাতে ব্লকে ব্লকে পথসভা করবে তারা। দলের রাজ্য সভাপতি দিলীপবাবুর তির্যক মন্তব্য, ‘‘বাংলার মানুষ জানে, চিট ফান্ডের টাকা কার কাছে আছে! যে দুই মুখ্যমন্ত্রী কালো টাকা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরব হয়ে ক্ষমতায় এসেছেন, তাঁরাই এখন কালো টাকা বাঁচাতে উঠেপড়ে লেগেছেন!’’
তবে এ সবের পরেও প্রশ্ন থাকছে, দিল্লিতে মোদী-বিরোধী ধর্নায় কংগ্রেস, তৃণমূল-সহ সব বিরোধী একসঙ্গে সামিল হলে রাজ্যে সূর্য-মান্নানদের পথে নামা কি ফিকে হয়ে যাবে না? সূর্যবাবুর মতে, ‘‘সংসদীয় রাজনীতিতে প্রতিবাদ সকলেই করতে পারে। কিন্তু ওঁরা (তৃণমূল) তো যৌথ সংসদীয় কমিটির দাবিতে নেই। আর চিট ফান্ডের টাকা কারা আত্মসাৎ করেছে এবং কারা আড়াল করেছে, এখন সবাই বুঝতে পারছে!’’ মান্নান জানাচ্ছেন, মোদী-মমতা যে ভাবে জাতীয় ও রাজ্য স্তরে বিরোধীদের নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করছেন, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ চলবেই।