ছবি: পিটিআই।
দিল্লির বিরোধী বৈঠকে না গিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দেখা করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর থেকেই প্রশ্ন এবং আগ্রহ দানা বাঁধছিল। শনিবার মোদী-মমতা বৈঠকের পরে জল্পনা আরও বাড়ল। রাজ্যে সিপিএম, কংগ্রেসের মতো দলগুলি মমতার বিরুদ্ধে আক্রমণের ঝাঁঝ তীব্র করেছে। খোঁচা দিয়েছে বিজেপি-ও। এমনকি, মোদীর সফরের বিরোধিতা করে পথে নামা আন্দোলনকারীদের মুখ থেকে মমতাকেও শুনতে হয়েছে ‘গো ব্যাক’।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার আগে-পরে মমতা অবশ্য বুঝিয়েছেন, মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তাঁর ‘সাংবিধানিক’ দায়িত্ব পালনের জন্যই তিনি এটা করলেন। তাঁর আরও দাবি, তিনি মোদীর কাছে রাজ্যের বিপুল পাওনার কথা বলে টাকা চেয়েছেন। সেই সঙ্গেই নয়া নাগরিক আইন (সিএএ), জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) এবং জাতীয় জনসংখ্যা রেজিস্টার (এনপিআর)-এর বিরুদ্ধে বক্তব্য জানিয়ে সেগুলি রদ করার দাবিও জানিয়েছেন। ঘটনা হল, মোদীর সঙ্গে বৈঠক সেরেই মমতা গিয়েছিলেন তৃণমূলের ছাত্রদের ধর্না মঞ্চে। সেখানে তাঁর বক্তৃতায় ছিল সিএএ, এনআরসি-র বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ডাক।
কিন্তু আসল প্রশ্ন হল, দিল্লিতে বিরোধী দলগুলির বৈঠক থেকে সমবেত ভাবে যে দাবি জানানোর জন্য মমতা সবার আগে উদ্যোগী হয়েছিলেন, সেখান থেকে ঘুরে গিয়ে হঠাৎ শেষ মুহূর্তে তাঁর এই অবস্থান কেন? এর সঠিক উত্তর এখনই দেওয়া কঠিন। মমতা প্রকাশ্যে কারণ ব্যাখ্যা করে আঙুল তুলেছেন বাম ও কংগ্রেসের ডাকা বন্ধে অশান্তির দিকে। বলেছেন, যারা গুন্ডামির বন্ধ করেছে তাদের পাশে তিনি বসবেন না। তবে পারিপার্শ্বিকতা বিচার করে আরও কিছু বিষয় সামনে আসে।
আরও পড়ুন: মোদীকে বলেছি সিএএ ফেরান, বললেন মমতা
নাগরিকত্ব-আন্দোলনের মতো গুরুতর একটি জাতীয় ‘সমস্যা’র মুখে দাঁড়িয়ে বাংলা বন্ধের দিনের কয়েকটি বিক্ষিপ্ত অশান্তিকে বড় করে দেখার যুক্তি কতটা ধোপে টেকে, রাজনৈতিক মহলে অবশ্য তা নিয়ে গোড়া থেকেই বিতর্ক তোলা হয়েছে। পর্যবেক্ষকেরাও অনেকে এর পিছনে আরও ‘গভীর’ কারণ থাকার কথা উড়িয়ে দিচ্ছেন না। কেন্দ্রীয় তদন্ত-সংস্থাগুলিকে ‘সক্রিয়’ করে তোলার আশঙ্কা যার অন্যতম।
কারও কারও মতে, কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধীর ডাকা ১৩ জানুয়ারির বৈঠকে গিয়ে সেখানেই মমতা অন্য বিরোধী নেতাদের উপস্থিতিতে সিপিএম এবং কংগ্রেস নেতৃত্বের কাছে নিজের ক্ষোভ জানাতে পারতেন। কিন্তু সরাসরি বৈঠক বয়কট করা বিষয়টিকে অন্য মাত্রা দিল। যা বিরোধীদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদের পরিপন্থী। তার পরেই কলকাতায় মোদী-মমতা একান্ত বৈঠক তাতে বাড়তি ইন্ধন জোগাল।
মমতা যখন সবার আগে নয়া নাগরিকত্ব বিল, এনআরসি, এনপিআর ইত্যাদির বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেছিলেন, তখন সংখ্যালঘু ভোট-ব্যাঙ্কের কথা অবশ্যই তাঁর ভাবনায় ছিল। কারণ নাগরিকত্বের নয়া বিধিতে সংখ্যালঘু অর্থাৎ মুসলিমদের উদ্বেগ বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। তৃণমূল নেত্রী তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর কথা বলছেন বারবার। নজরে অবশ্যই রাজ্যের প্রায় ৩০ শতাংশ মুসলিম ভোট।
তবু সেই আন্দোলনের জাতীয় মঞ্চ ছেড়ে তিনি মোদীর সঙ্গে একান্ত বৈঠকে বসায় তাঁর সেই ভোট ব্যাঙ্কটিও কি অটুট থাকবে? বাম এবং কংগ্রেসের মতো বিজেপি-বিরোধী দলগুলি যে মমতার এই ‘বদলকে’ তুলে ধরে সংখ্যালঘু ভোটে ভাঙন ধরানোর চেষ্টা করবে, সেটাই স্বাভাবিক। আর কিছুমাত্র ভাগ বসাতে পারলে তাতে আখেরে মমতার লাভবান হওয়ার কথা নয়। তা সত্ত্বেও তিনি এমন একটি ঝুঁকি নিলেন কেন?
তা হলে ধরে নেওয়া যায়, তাঁর বিরোধী মঞ্চ বর্জন করে মোদীর সঙ্গে বৈঠকের আরও বড় কারণ আছে। সেটা কী হতে পারে? প্রশ্ন উস্কে দিয়েছেন বিরোধী নেতারাই। দিলীপ ঘোষের মতো বিজেপি নেতা যেমন বলছেন, সিবিআই, ইডি-র নজরে থাকা তৃণমূল নেতাদের বাঁচাতেই ‘দিদি’ তড়িঘড়ি মোদীর শরণাপন্ন। সিপিএমের মহম্মদ সেলিমের কটাক্ষ, ‘‘মোদী, দিদি দুজনেই ভাল অভিনেতা। তাই আসলটা লুকিয়ে যেন যাত্রাপালা করছেন। টাকা চাইতে বৈঠক করতে গেলে অর্থমন্ত্রী এবং অফিসাররা সঙ্গে গেলেন না কেন?’’ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্রের বক্তব্য, যাঁরা মমতার সঙ্গে সিএএ, এনআরসি বিরোধী মিছিলে হাঁটলেন, তাঁদের সঙ্গেই তিনি তঞ্চকতা করলেন।
দিল্লিতে কংগ্রেসের সর্বভারতীয় নেতা আনন্দ শর্মার প্রতিক্রিয়াতেও খোঁচা স্পষ্ট। তিনি বলেছেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী বৈঠক করতেই পারেন। কিন্তু এখন দেশের যা পরিস্থিতি, তাতে সব দলেরই একজোট হওয়া উচিত।’’