দুষ্কৃতী-দৌরাত্ম্যে তৃণমূলকেই দুষছে বিরোধীরা

ক্রমশ অশান্ত হয়ে উঠছে নদিয়ার বেশ কিছু এলাকা। কখনও দুষ্কৃতী কিংবা সমাজবিরোধীদের দৌরাত্ম্য, কখনও রাজনৈতিক চাপানউতোরে গত কয়েক মাসে খুন হয়েছেন বেশ কয়েকজন। জখমের সংখ্যাও কম নয়। রবিবার সেই তালিকায় সংযোজন হল সীমান্তবর্তী কৃষ্ণগঞ্জও। জমির দখলকে কেন্দ্র করে দুষ্কৃতীদের গুলিতে খুন হলেন ঘুঘড়াগাছির এক মহিলা। গুলিবিদ্ধ হয়েছেন আরও তিন জন। রাজ্যের বিরোধী দলগুলো তো বটেই, সাধারণ মানুষও জেলা জুড়ে একের পর এক এমন ঘটনার জন্য দায়ী করছেন পুলিশ প্রশাসন ও শাসক দলকে।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০১৪ ০২:৫৭
Share:

ঘটনাস্থলে পড়ে আছে গুলির খোল। —নিজস্ব চিত্র।

ক্রমশ অশান্ত হয়ে উঠছে নদিয়ার বেশ কিছু এলাকা। কখনও দুষ্কৃতী কিংবা সমাজবিরোধীদের দৌরাত্ম্য, কখনও রাজনৈতিক চাপানউতোরে গত কয়েক মাসে খুন হয়েছেন বেশ কয়েকজন। জখমের সংখ্যাও কম নয়। রবিবার সেই তালিকায় সংযোজন হল সীমান্তবর্তী কৃষ্ণগঞ্জও।

Advertisement

জমির দখলকে কেন্দ্র করে দুষ্কৃতীদের গুলিতে খুন হলেন ঘুঘড়াগাছির এক মহিলা। গুলিবিদ্ধ হয়েছেন আরও তিন জন। রাজ্যের বিরোধী দলগুলো তো বটেই, সাধারণ মানুষও জেলা জুড়ে একের পর এক এমন ঘটনার জন্য দায়ী করছেন পুলিশ প্রশাসন ও শাসক দলকে। অভিযোগ, তৃণমূলের প্রশ্রয়ে দুষ্কৃতী ও সমাজবিরোধীদের এই দৌরাত্ম্য ক্রমে বেড়েই চলেছে। এ দিকে সব জেনেও ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসে রয়েছে প্রশাসন!

শাসক দলের নেতা কিংবা জেলা প্রশাসনের কর্তারা প্রকাশ্যে এমন অভিযোগ মানতে না চাইলেও জেলা পুলিশের এক আধিকারিক কোনও রাখঢাক না রেখেই বলেছেন, “পুলিশ চাইলে অনেক কিছুই করতে পারে। কিন্তু বাস্তব এটাই যে, দুষ্কৃতীরা সব সময় ক্ষমতাসীন দলের কোনও না কোনও নেতার ছত্রছায়ায় থাকে। সেই নেতারা নিজেদের স্বার্থে এদের ‘শেল্টার’ দেন। সেই কারণে খুব বড় কোনও ঘটনা না ঘটলে সব জেনেও আমরা এদের ছঁুতে পারি না।”

Advertisement

বিরোধী দলগুলি ও সাধারণ মানুষের অভিযোগ যে মিথ্যে নয়, তা ফের একবার প্রমাণ করে দিল কৃষ্ণগঞ্জের এই ঘটনা। ২২ বিঘা জমির দখলকে কেন্দ্র করে বেশ কয়েক মাস ধরেই ভিতরে ভিতরে অশান্ত হয়ে উঠছিল কৃষ্ণগঞ্জের ঘুঘড়াগাছি। সম্প্রতি ওই জমিতে যাঁরা চাষ করেন তাঁদের বেশ কয়েকজনকে খুনের হুমকি ও মারধরের অভিযোগ উঠেছিল লঙ্কেশ্বর ঘোষ (রবিবারের ঘুঘড়াগাছির ঘটনায় অন্যতম অভিযুক্ত) ও তাঁর দলবলের বিরুদ্ধে। পুলিশকে সে কথা জানানোও হয়েছিল। কিন্তু তারপরেও পুলিশ কোনও পদক্ষেপ করেনি বলে অভিযোগ। সে কথা অজানা ছিল না পুলিশ প্রশাসন থেকে শুরু করে স্থানীয় তৃণমূল নেতাদেরও। পুলিশ জানিয়েছে, বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু হয়েছিল। আর কৃষ্ণগঞ্জ ব্লক তৃণমূলের সভাপতি লক্ষ্মণ ঘোষচৌধুরী বলেন, “বিষয়টি আমরাও শুনেছিলাম। সেটা যে এমন বাড়াবাড়ি পর্যায়ে যাবে বুঝতে পারিনি।”

এলাকায় লঙ্কা ঘোষ নিজের এলাকায় পাচার ও বেআইনি জমি কারবারি বলে পরিচিত। লঙ্কা নিজেও এ দিন বুক ঠুকে বলেছেন, “হ্যাঁ, আমি তৃণমূল করি। নেতারাও আমাকে চেনেন। এতে অন্যায় কী আছে?”

তবে তৃণমূল ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত লঙ্কার নাম এ দিনের ঘটনায় প্রকাশ্যে আসায় অস্বস্তিতে পড়েছে শাসক দল। লঙ্কার সঙ্গে দলের দূরত্ব বাড়াতে মরিয়া হয়ে উঠছেন স্থানীয় তৃণমূলের নেতারাও। খোদ লক্ষ্মণবাবু এ দিন বলেছেন, “লঙ্কা তো গরু পাচারকারী, সমাজবিরোধী। তাই তাঁকে আমাদের দলের কাছাকাছি ঘেঁষতে দিইনি।”

গ্রামবাসীদের একাংশ জানান, মুখ বাঁচাতে শাসক দল ও প্রশাসন সকলেই তাদের দায় ঝেড়ে ফেলতে চাইছে। কিন্তু সেটা করে তো আর সত্যিটাকে অস্বীকার করা যায় না। স্থানীয় কয়েকজন গ্রামবাসীর কথায়, “লঙ্কা এবং তাঁর দলবলের প্রভাব রয়েছে এলাকায়। শাসক দলও তাদের প্রয়োজন মতো ভোট থেকে শুরু করে অন্য কাজকর্মে ব্যবহার করে। আর সেই কারণেই সব জেনেও পুলিশ চুপ করে থাকতে বাধ্য হয়। শাসক দলের চাপে এখন পুলিশ যে কতটা অসহায় হয়ে পড়েছে তা সংবাদমাধ্যমের দৌলতে সকলেরই জানা। আমরাও তা টের পাচ্ছি।”

কৃষ্ণগঞ্জ একা নয়, গোটা জেলাই এখন যেন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। কৃষ্ণনগরের এক সমাজকর্মীর কথায়, “শাসক দল বা প্রশাসন মুখে যাই বলুক না কেন, অজুহাত দিয়ে এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। নিজেদের দায় এড়িয়ে না গিয়ে মূল সমস্যাটার কী ভাবে সমাধান হবে সেটা নিয়েই সকলের ভাবা উচিত। প্রয়োজনে প্রশাসন সর্বদল বৈঠক ডেকেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে পারে।”

প্রশাসনের একাংশও মেনে নিচ্ছে যে জেলার বেশ কিছু জায়গায় পরিস্থিতি ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। জেলা প্রশাসনের এক কর্তা বলছেন, “এমনটা যে হতে পারে তা লোকসভা ভোটের আগে থেকেই আমরা আন্দাজ করছিলাম। কারণ এই জেলার রাজনৈতিক সমীকরণ ক্রমশ বদলে যাচ্ছে। বিধানসভা ভোটের আগে আরও অনেক কিছু ঘটতে পারে।”

সিপিএমের এক জেলা নেতা বলছেন, “আমাদের আশঙ্কাটাও ঠিক এই জায়গায়। কৃষ্ণগঞ্জের বিধায়ক তৃণমূলের সুশীল বিশ্বাস সম্প্রতি মারা গিয়েছেন। সেই উপ নির্বাচনের জন্য সব রাজনৈতিক দলই প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। ফলে এলাকায় আতঙ্ক তৈরির জন্য তৃণমূল যে এটা করতে পারে তেমন একটা আশঙ্কা আমাদেরও ছিল। কিন্তু ওরা যে এতটা নৃশংস হয়ে উঠবে তা ভাবতে পারিনি। এক্ষেত্রে আমরা তাকিয়ে আছি পুলিশ কী ব্যবস্থা নেয় তা দেখার জন্য।”

রবিবার রাত পর্যন্ত পুলিশ ওই ঘটনায় অভিযুক্ত কাউকেই গ্রেফতার করতে পারেনি। ঘটনায় অন্যতম অভিযুক্ত লঙ্কা ঘোষ বহাল তবিয়তে রয়েছেন এলাকাতেই। অথচ পুলিশ বলছে, লঙ্কা পলাতক। ঘটনার প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়ে জেলার পুলিশ সুপার অর্ণব ঘোষকে বেশ কয়েকবার ফোন ও এসএমএস করা হয়। রাতে এসএমএসে তিনি জানান, এখনও পর্যন্ত অভিযুক্তরা অধরা। যা শুনে বিরোধীদের কটাক্ষ, পুলিশ তো এখন তল্লাশি চালায় না কানামাছি খেলে বোঝা দায়!

জেলা জুড়ে দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্য ক্রমে বেড়েই চলেছে। মাস দুয়েক আগে কৃষ্ণনগরে সমাজবিরোধীদের নিজেদের মধ্যে গুলির লড়াই চলছিল। শহরে নেমে রিকশায় এক শ্রাদ্ধানুষ্ঠান বাড়ি যাওয়ার পথে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান এক ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্র। সেই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে কালীপুজোর সময় দুষ্কৃতীর গুলিতে খুন হন আসাননগরের এক স্কুল শিক্ষক। দিনকয়েক আগে কৃষ্ণনগর শহরের কাছে, দুর্গাপুরে দুষ্কৃতীদের ছোড়া গুলিতে জখম হন এক নৈশপ্রহরী। শান্তিপুরেও সমাজবিরোধীদের গন্ডগোলের মধ্যে পড়ে গুলিবিদ্ধ হন এক বৃদ্ধা। গত জুন মাসে কৃষ্ণনগর থেকে বাড়ি ফেরার পথে খুন হন নারায়ণপুরের এক তৃণমূল নেতা। ওই ঘটনার কিছুক্ষণের মধ্যেই বদলা নিতে স্থানীয় গ্রাম পঞ্চায়েত ভবনে ঢুকে এক সিপিএম সদস্যকে খুন করা হয়েছিল। গত কয়েক মাসে এই তালিকাটা আরও দীর্ঘ হয়েছে।

কিন্তু এত কিছুর পরেও তৃণমূলের জেলা সভাপতি গৌরীশঙ্কর দত্ত বলছেন, “এ সবই মিথ্যে অভিযোগ। দুষ্কৃতীরা দুষ্কৃতীই। তাদের সঙ্গে আমাদের কোনও সম্পর্ক নেই। আমরাও চাই এই ঘটনা যারা ঘটিয়েছে তাদের শাস্তি হোক।” সিপিএমের জেলা সম্পাদক সুমিত দে বলেন, “পায়ের তলায় মাটি শক্ত নেই বুঝে সর্বত্রই সন্ত্রাস চালিয়ে নিজের ক্ষমতা জাহির করতে চাইছে তৃণমূল। পরিকল্পিত ভাবেই কৃষ্ণগঞ্জে এ দিনের ঘটনা ঘটিয়েছে তৃণমূল।”

জেলা বিজেপির মুখপাত্র সৈকত সরকার বলেন, “পুলিশকে ব্যবহার করে দুষ্কৃতীদের কাজে লাগিয়ে তৃণমূল যে ভয়ঙ্কর খেলা শুরু করেছে তার পরিণতি কিন্তু ভয়ঙ্কর হবে। প্রশাসন যদি এখনও সতর্ক না হয় তাহলে তার মাসুলও দিতে হবে।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement