দেড় দশক আগে রিজওয়ানুর রহমানের মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশের ভূমিকার বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে তৎকালীন বাম সরকারের মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছিল তৃণমূল কংগ্রেস। নেতৃত্বে ছিলেন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়।
আনিস খানের মৃত্যুর বিচার চেয়ে কলকাতার রাজপথে। নিজস্ব চিত্র।
বিচারের দাবিতে এক দিকে রাস্তায় উত্তাল বিক্ষোভ। তারই পাশাপাশি ছাত্র-নেতা আনিস খানের মৃত্যুর ঘটনায় সরকারের উপরে চাপ বাড়াচ্ছে বিরোধীরা।
দেড় দশক আগে রিজওয়ানুর রহমানের মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশের ভূমিকার বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে তৎকালীন বাম সরকারের মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছিল তৃণমূল কংগ্রেস। নেতৃত্বে ছিলেন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। এখন ছাত্র-নেতা আনিস খানের মৃ্ত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে একই ভাবে রাস্তায় প্রতিবাদী আন্দোলনের পাশাপাশি পুলিশমন্ত্রী মমতার ইস্তফা চেয়ে সরব হয়েছে বিরোধী বামেরা। রিজ়ওয়ানুর-কাণ্ডে যে আইপিএস অফিসারের বিরুদ্ধে সরব ছিলেন বিরোধী মমতা, আনিস-কাণ্ডে মুখ্যমন্ত্রী মমতা সেই জ্ঞানবন্ত সিংহকেই তদন্তের ভার দেওয়ায় একই তির তাঁর দিকে ফিরিয়ে দিচ্ছে বিরোধীরা। আবার সে সময়ের শাসকদের মতো এখনকার সরকার পক্ষ তথা তৃণমূল নেতৃত্ব বিরোধীদের দিকে ছাত্র-নেতার পরিবারকে ‘ভুল পথে পরিচালনা’ এবং প্ররোচনার রাজনীতি করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করার অভিযোগে পাল্টা আঙুল তুলছেন।
আর এরই মধ্যে নিজস্ব রাজনৈতিক অঙ্কে ঘোলা জলে মাছ ধরার চেষ্টায় নেমেছে বিজেপি! সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু তাস সামনে এনে তাদের মত, আনিস সংখ্যালঘু বলেই এখন সকলে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। রাজ্যে বিধানসভা ভোট-পরবর্তী হিংসায় বিজেপির অনেক কর্মী মারা গেলেও সকলে মুখে কুলুপ এঁটে ছিল!
আনিস-কাণ্ডে দৃশ্যতই রাস্তার আন্দোলনের রাশ নিয়েছে বামেরা। বিভ্রান্তি ছড়িয়ে এবং দোষারোপের খেলা খেলে অপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টা হচ্ছে বলে অভিযোগ করে এ বার সরাসরি পুলিশমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে সরব হয়েছে সিপিএম। আমতায় আনিসের বাড়িতে ঘটনার রাতে পুলিশ গিয়েছিল, নাকি পুলিশের পোশাকে অন্য কেউ, এই নিয়ে কয়েক দিন ধোঁয়াশা বজায় রাখছিলেন পুলিশ-কর্তারা। শেষ পর্যন্ত মঙ্গলবার তিন পুলিশকর্মীকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট না হয়ে ঘটনার পিছনে আসল মাথাদের খুঁজে বার করার দাবি তুলেছে বিরোধীরা। তাদের প্রশ্ন, কার নির্দেশে পুলিশকর্মীরা কাজ করেছিলেন? হাওড়া জেলা (গ্রামীণ) পুলিশ সুপারের অপসারণ এবং প্রয়োজনে গ্রেফতারের দাবিতেও সরব তারা।
কলকাতায় এ দিন সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী বলেছেন, ‘‘রিজ়ওয়ানুরের দুঃখজনক ঘটনায় তদানীন্তন বিরোধী নেত্রী যাঁকে অভিযুক্ত করেছিলেন, তাঁকেই এখন সিটের দায়িত্ব দিলেন। এই তদন্ত কেউ বিশ্বাস করবে? ছেলেটি (আনিস) নিরাপত্তা চেয়ে থানায় চিঠি দিয়েছিল। নিরাপত্তা দেননি। ঘটনার চার দিন পরে কেউ ধরা পড়েনি, দোষারোপের খেলা চলেছে। এখন তদন্তকে ধামাচাপা দিতে চাইছেন। পুলিশমন্ত্রীর পদে থাকার অধিকার নেই! তাঁর অবশ্যই পদত্যাগ করা উচিত।’’ একই সুরে বর্ধমানে সিপিএমের পলিুটবুরো সদস্য মহম্মদ সেলিমের বক্তব্য, ‘‘প্রথমে মুখ্যমন্ত্রী বললেন, পুলিশ যায়নি। তার পরে স্পষ্ট হল, পুলিশ গিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে নিচু তলার কয়েকজন পুলিশকে সাসপেন্ড করা হল। কেন? তা হলে কি হাওড়া গ্রামীণের পুলিশ সুপারকে আড়াল করা হচ্ছে? আনিসের ঘটনায় এসপি বা পুলিশমন্ত্রী দায় এড়াতে পারেন?’’ আনিসের বাবা আমতা থানায় ফোন করার ৬ ঘণ্টা পরে পুলিশ এসেছিল অথচ কলকাতায় ছাত্রদের প্রতিবাদ আন্দোলনে শ’য়ে শ’য়ে পুলিশ পাঠানো নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন সেলিম।
বিরোধীদের পাল্টা বিঁধে রাজ্যের মন্ত্রী তথা তৃণমূল কংগ্রেসের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য বলেছেন, ‘‘রাজনৈতিক দলগুলি এক হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে একটা পরিস্থিতি তৈরি করতে চাইছে। যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে তারা সংখ্যালঘু তোষণের অভিযোগ করে, সেই মমতার উপরে সংখ্যালঘু মানুষের আস্থা থাকবে না, এটা হয় না কি! মুখ্যমন্ত্রী ১৫ দিনের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন। প্রশাসনিক পদক্ষেপ হয়েছে বলেও শুনেছি। তদন্তে সন্তুষ্ট না হলে তখন ফের এ নিয়ে কথা হতে পারে। তবে এই ভাবে আনিসের পরিবারকে ভুল পথে চালিত করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা নেতিবাচক রাজনীতি।’’ কিন্তু কেন সেই জ্ঞানবন্তকে দায়িত্ব? পার্থবাবুর বক্তব্য, ‘‘এটা তো সরকারের সিদ্ধান্ত। কোন তদন্তে কে দায়িত্ব পাবেন, সে ব্যাপারে দলের কিছু বলার থাকতে পারে না।’’ শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুও এ দিন বোলপুরে বলেছেন, ‘‘অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক একটি ঘটনা। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, শেষ পর্যন্ত পরিবারকে সাহায্য থেকে শুরু করে তদন্ত, সব কিছুতেই মুখ্যমন্ত্রী সাহায্য করবেন। অন্য রাজনৈতিক দলের কেউ তা করবেন না, প্রতারণা করে উত্তেজনা তৈরি করে চলে যাবেন!’’
বিরোধীরা অবশ্য মুখ্যমন্ত্রী বা সরকারের কথায় একেবারেই আস্থা রাখছে না। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী যেমন এ দিন কাঁথিতে সরাসরিই রাজ্য সরকার ও পুলিশের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘যে মুখ্যমন্ত্রী বিধানসভা ভোটের আগে বলেছিলেন বিজেপি রাজ্যে ক্ষমতায় এলে এনআরসি করে মুসলিমদের তাড়িয়ে দেবে, তাঁর পুলিশই এক জন মুসলিম ভাইকে খুন করেছে। আনিস একটা পোস্ট করার পরে তৃণমূল বিধায়কের স্বামী তথা হাওড়া জেলার পুলিশ সুপার এবং অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (গ্রামীণ)-এর নির্দেশে অভিযান হয়েছে। আর এখন নিচু তলার পুলিশকর্মীদের শাস্তি দেওয়া হচ্ছে।’’ আনিস খুনের তদন্তের জন্য রাজ্য সরকারের তরফে যে তিন সদস্যের ‘সিট’ গঠন করা হয়েছে, তারও সমালোচনা করেন শুভেন্দু। তাঁরও দাবি, ‘‘সিট দিয়ে কিছুই হবে না। আনিসের বাবা যদি ছেলের খুনের প্রতিবাদ চেয়ে আদালতে যান, তবে শুভেন্দু তাঁর পাশে থাকবে। এই ঘটনায় সিবিআই একমাত্র সমাধান।’’ প্রাক্তন বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নানের প্রশ্ন, ‘‘যাঁর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল বলে মুখ্যমন্ত্রী বললেন, সেই ছাত্র-নেতার বিরুদ্ধে পুলিশ মামলা দিয়ে রাখল? রিজ়ওয়ানুর-কাণ্ডে যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেন, তাঁকেই এখানে তদন্তের দায়িত্ব দিলেন? মানুষ বুঝতে পারছেন, প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টা করছে সরকার।’’
আনিস-কাণ্ডে দোষীদের শাস্তি দাবি করেও বিজেপির সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি দিলীপ ঘোষের মন্তব্য, ‘‘আনিস বহু লোকের সঙ্গে বহু সময়ে আন্দোলনে শামিল হয়েছে। এখন আইএসএফ, সিপিএম, তৃণমূলও তাঁকে নিজেদের লোক বলে দাবি করছে। যে হেতু মুসলিম, তাই সকলে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ভোট-পরবর্তী হিংসায় আমাদেরও বহু কর্মী মারা গিয়েছেন। তখন সবাই মুখে কুলুপ এঁটেছিল! তখন কারও মনে হয়নি এগুলো অমানবিক!’’ এসইউসি-র রাজ্য সম্পাদক চণ্ডীদাস ভট্টাচার্যেরও দাবি, ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক। আর্থিক ক্ষতিপূরণ বা চাকরির প্রসঙ্গ এনে পরোক্ষে তদন্তের দায়ভার এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টার সমালোচনাও করেছেন তিনি।
সরকারের তরফে মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম এ দিন ফের মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘‘যারা অন্যায় করেছে, তাদের শাস্তি হবে। বিচার ব্যবস্থা তা দেখবে। রাজ্য নিরপেক্ষ তদন্ত করবে। আমাদের মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, আমি দোষী হলে আমিও ছাড় পাব না। পুলিশ অন্যায় করলেও তার শাস্তি হবে। সিবিআই তদন্ত করলেই কি নিরপেক্ষ?’’