গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
পুলিশকে গাছে বেঁধে রাখুন, বাঁশ-বঁটি নিয়ে আক্রমণ করুন অথবা পুলিশ জল চাইলে তা-ও দেবেন না। পর পর ভেসে আসছিল জ্বালাময়ী কথাগুলো। কোনও সংশয় নেই যে, প্রায় প্রতিটি উক্তিতেই উস্কানি ছিল। তাই পুলিশ অত্যন্ত তৎপর হয়ে উঠল। ওই সব মন্তব্য করার পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার হয়ে গেলেন উত্তর দিনাজপুর জেলা বিজেপি-র সভাপতি শঙ্কর চক্রবর্তী। তুমুল বিতর্ক শুরু হয়েছে সেই গ্রেফতারিকে ঘিরেই। আইনজীবী থেকে রাজনীতিক, বিরোধী দলের নেতা থেকে আমজনতা— প্রত্যেকের প্রশ্ন, অনুব্রত মণ্ডল, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বা রবীন্দ্রনাথ ঘোষদের বেলায় পুলিশের এই ‘বিক্রম’ কোথায় যায়?
শঙ্কর চক্রবর্তীর গ্রেফতারির বিষয়ে রবিবার বিবৃতি দেন খোদ এডিজি (আইন-শৃঙ্খলা) অনুজ শর্মা। তিনি বলেন, হাতে মাইক্রোফোন থাকলেই যে কেউ যা খুশি বলতে পারেন না। বিজেপি-র জেলা সভাপতি উস্কানিমূলক কথা বলেছেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করা হবেই।বেশ জোর গলায় জানিয়ে দেন অনুজ।
সোমবার সেই প্রসঙ্গেই ওই পুলিশকর্তাকে তীব্র আক্রমণ করলেন কংগ্রেস নেতা তথা কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী অরুণাভ ঘোষ। তিনি বললেন, ‘‘অনুজ শর্মা হলেন এক শিরদাঁড়াহীন পুলিশ অফিসার। শঙ্কর চক্রবর্তী বিজেপি নেতা বলে অনুজ শর্মা এত বড় বড় কথা বলছেন। অনুব্রত মণ্ডল যখন এর চেয়েও মারাত্মক কথাগুলো বলেন, তখন এই অনুজ শর্মার মতো অফিসারদের খুঁজেই পাওয়া যায় না।’’
আরও পড়ুন: পুলিশ হেফাজতে অসুস্থ বিজেপির জেলা সভাপতি, জেল হেফাজতে পাঠাল আদালত
আরও পড়ুন: বিজেপির বাংলা বন্ধকে বেআইনি ঘোষণা করতে হাইকোর্টে জোড়া মামলা
অরুণাভ অবশ্য শুধু অনুজ শর্মাকে আক্রমণ করে থামেননি, তিনি সরাসরি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিকে আঙুল তুলেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘পশ্চিমবঙ্গকে পুরোপুরি পুলিশ স্টেটে পরিণত হয়েছে। পুলিশকে অসীম ক্ষমতা দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। শর্ত একটাই— ওই ক্ষমতা শাসক দলের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা যাবে না।’’ অরুণাভ ঘোষ আরও বললেন, ‘‘আমি অনেক দিন ধরেই পুলিশের এই বিপজ্জনক আচরণের বিরুদ্ধে সরব। আমি কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতিদেরও বলেছি যে, আমরা ধীরে ধীরে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে সরে গিয়ে পুলিশ রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছি, কিন্তু বিচারবিভাগ কিছুই করছে না।’’
কলকাতা হাইকোর্টের আর এক আইনজীবী জয়ন্ত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ও সহমতঅরুণাভ ঘোষের সঙ্গে। শঙ্কর চক্রবর্তীর বিপজ্জনক মন্তব্যগুলোকে তিনি একেবারেই সমর্থন করছেন না। গ্রেফতারিরও বিরোধিতা করছেন না। কিন্তু জয়ন্ত নারায়ণের কথায়, ‘‘একজন বিজেপি নেতা উস্কানি দিলে তাঁকে প্রতিহত করার জন্য যদি গ্রেফতার করতে হয়, তা হলে একজন তৃণমূল নেতার ক্ষেত্রেও সেই একই নীতি নেওয়া উচিত। আইনের চোখে শঙ্কর চক্রবর্তীও যা, অনুব্রত মণ্ডল, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকও তা-ই। কিন্তু শঙ্কর চক্রবর্তী উস্কানি দেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার হলেন। আর পুলিশকে বোমা মারতে বলা অনুব্রত বা বিষধর সাপ নিধনের ঢঙে সিপিএম নিধনের নিদান দেওয়া জ্যোতিপ্রিয়র বিরুদ্ধে পুলিশ টুঁ শব্দটাও করল না।’’ ওই আইনজীবীর প্রশ্ন, ‘‘একে পুলিশ-প্রশাসনের চূড়ান্ত নির্লজ্জতা ছাড়া আর কী বলব?’’
রাজ্যের এডিজি(আইন-শৃঙ্খলা)-কে নিশানা করেছেন জয়ন্ত নারায়ণও। তিনি বলেন, ‘‘অনুজ শর্মা যে কথাগুলো বললেন, সেগুলো তো আমরা অনুব্রত মণ্ডলের সময়েও আশা করেছিলাম। বীরভূম জেলা তৃণমূলের সভাপতির বেলায় পুলিশ চুপ। আর উত্তর দিনাজপুর জেলা বিজেপির সভাপতির বেলায় পুলিশ অতিসক্রিয়। এটা মানব কী ভাবে!’’ কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী মনে করছেন, অনুব্রত-জ্যোতিপ্রিয়দের যদি পুলিশ না ধরতে পারে, তা হলে শঙ্কর চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করাও পুলিশের উচিত হয়নি।
বিজেপি স্বাভাবিক ভাবেই তীব্র নিন্দা করছে শঙ্কর চক্রবর্তীর গ্রেফতারির। সোমবার দিনভর ইসলামপুরে মিছিল-ধর্না-প্রতিবাদে নেতৃত্ব দিয়েছেন রাজ্য বিজেপির সাধারণ সম্পাদক রাজু বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর মুখেও সেই বীরভূমের অনুব্রত মণ্ডল, উত্তর ২৪ পরগনার জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক এবং কোচবিহারের রবীন্দ্রনাথ ঘোষের নাম। রাজুর কথায়, ‘‘এই ভাবে আমাদের দমাতে পারবে না। রাজ্যের পুলিশ নিজেকে জঘন্য পর্যায়ে নামিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বুধবারের বন্ধে পুলিশ এবং প্রশাসনের কর্তারা জবাবটা পাবেন।’’
এই গোটা বিতর্কে তৃণমূল কিন্তু চুপ। একাধিক নেতাকে ফোন করা হয়েছিল প্রতিক্রিয়ার জন্য। কারও প্রতিক্রিয়া মেলেনি।