লঘু ধারায় মামলা করার অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে। ফাইল চিত্র।
বিস্ফোরণে উড়ে গেল বাড়ি, মৃত্যু হল অন্তত ৮ জনের। তার পরেও লঘু ধারায় মামলা করার অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর দাবি, বিস্ফোরক আইনে মামলা করা হয়নি। যদিও প্রশাসনের বক্তব্য, ভারতীয় দণ্ডবিধির বিস্ফোরক ব্যবহার ও তার ফলে পারিপার্শ্বিক ক্ষয়ক্ষতির ধারা যুক্ত করা হয়েছে। শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের তরফেও ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে, বিস্ফোরণের তথ্যপ্রমাণ-সহ ফরেন্সিক রিপোর্ট আসার আগে বিস্ফোরক আইনের ধারা দিলে মামলা দুর্বল হয়ে যাওয়ারই আশঙ্কা থাকে। এই ঘটনায় মূল অভিযুক্ত তথা বাজি কারখানার মালিক কৃষ্ণপদ বাগ ওরফে ভানুর খোঁজ এখনও পায়নি পুলিশ। স্থানীয়দের অভিযোগ, পুলিশ এমন ভাবে মামলা সাজায়, তাতে ধরা পড়লেও কয়েক মাস জেলে থেকে ছাড়া পেয়ে যান কৃষ্ণপদ। গ্রামে গেলে এই নিয়েই বিক্ষোভের মুখে পড়েন তৃণমূলের প্রতিনিধিরা। অন্য দিকে, শুভেন্দু এনআইএ তদন্ত চেয়ে হাই কোর্টেও মামলা করেন। খাদিকুলে গিয়ে তিনি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদত্যাগও দাবি করেন।
পূর্ব মেদিনীপুরের এগরায় খাদিকুল গ্রামে মঙ্গলবার কৃষ্ণপদের বেআইনি বাজি কারখানায় বিস্ফোরণে প্রাণ হারান অলোক মাইতি (২০), অম্বিকা মাইতি (৪৮), মাধবী বাগ (৩২), শক্তিপদ বাগ (৪২), জয়ন্ত জানা (৩৫), শ্যামশ্রী মাইতি (৩২), কবিতা বাগ (৪০) ও মিনতি মাইতি (৪২)। সকলেই খাদিকুলের বাসিন্দা। ওই ৮টি দেহ কাঁথি মহকুমা হাসপাতালে ময়না তদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে। যে দু’জন জখম হয়েছেন, তাঁরা কলকাতায় ভর্তি।
মামলা-নামা
• অভিযুক্ত: কৃষ্ণপদ বাগ, পৃথ্বীজিৎ বাগ (কৃষ্ণপদের ছেলে)-সহ তিন জন।
• মামলা: ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৮৮ ধারা: সরকারি নির্দেশ অমান্য করে একই অপরাধ সংগঠিত করা এবং তার জন্য এলাকায় অশান্তি।
• সাজা: এক মাসের কারাদণ্ড ও ২০০ টাকা জরিমানা।
• ২৮৬ ধারা: বিস্ফোরক ব্যবহার, তার ফলে অবহেলা জনিত কারণে মানুষের ক্ষতি।
• সাজা: সর্বাধিক ৬ মাসের কারাবাস ও হাজার টাকা জরিমানা।
• ৩০৪ ধারা: অনিচ্ছাকৃত খুন। সাজা: সর্বাধিক যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
এ ছাড়া
• দমকল আইনের ২৫ নম্বর ধারা: অনুমতি ছাড়া রকেট, একই জাতীয় কিছু জিনিস যেতে দেওয়া।
• ২৬ নম্বর ধারা: অনুমতি ছাড়া বাজি কারখানা খোলা।
পুলিশ সূত্রে দাবি, কৃষ্ণপদ-সহ একাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনিচ্ছাকৃত খুন, বিস্ফোরক আইন-সহ একাধিক ধারায় মামলা রুজু হয়েছে। তবে সে ক্ষেত্রে লঘু ধারা দেওয়ার অভিযোগ করেছেন শুভেন্দু। তিনি বলেন, ‘‘রাজ্য যে এফআইআর করেছে, তাতে ‘এক্সপ্লোসিভ অ্যাক্ট’ দেওয়া হয়নি। দেওয়া হয়েছে অগ্নিকাণ্ড সংক্রান্ত ধারা।’’ তাঁর দাবি, এই মামলার তদন্ত এনআইএ-রই করা উচিত। তিনি দাবি করেন, মালিপাঁচঘড়ায় যে অমিত মিত্র আইসি ছিলেন, বিষমদ-কাণ্ডে যাঁকে সরানো হয়েছিল, তাঁকেই এগরা কাণ্ডের তদন্তভার দেওয়া হয়েছে।
রাজ্যের মন্ত্রী তথা তৃণমূল নেতা ফিরহাদ হাকিমের পাল্টা মত, ‘‘কী পদার্থ ব্যবহার করে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে বা কী ধরনের বিস্ফোরণ, সে সব না জেনেই ধারা দিয়ে দিলে আদালতে প্রশ্ন উঠতে পারে। তখন মামলা দুর্বল হয়ে যাবে। ফরেন্সিক রিপোর্ট জমা পড়লে তখন আবার পদক্ষেপ করা যেতে পারে।’’
বাঁ দিকে, শুভেন্দু অধিকারীর সামনে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন মৃত এবং আহতের পরিজন। ডান দিকে, বিক্ষোভের মুখে মানস ভুঁইয়া, দোলা সেন। বুধবার এগরার খাদিকুল গ্রামে। ছবি: শুভেন্দু কামিলা ও নিজস্ব চিত্র।
বিস্ফোরণস্থলে মঙ্গলবার রাতেই গিয়েছিলেন রাজ্য এসটিএফের এডিজি জ্ঞানবন্ত সিংহ। গোটা এলাকা এ দিন সকাল থেকে ঘিরে দেয় পুলিশ। ঘিরে দেওয়া হয়েছিল পাশের পুকুরের চার দিকও। সিআইডি এবং বম্ব স্কোয়াডের সদস্যেরা তদন্তে আসেন। চলে মাপজোক, নমুনা সংগ্রহ। কী ধরনের বিস্ফোরক ছিল, তা জানতে সিআইডি-র তরফে পিএসআই (পাউন্ড পার স্কোয়ার ইঞ্চ) পরীক্ষা করা হয়।
কৃষ্ণপদ অবশ্য সপরিবার পলাতক। স্থানীয়দের দাবি, বিস্ফোরণে জখম হয়ে তিনি ওড়িশা পালিয়েছেন। বাজি কারখানার উল্টো দিকে দোতলা বাড়ি প্রদীপ মাইতির। তাঁর দাবি, ‘‘বিস্ফোরণের পরে ভানুদা তাঁর ভাইপোর গাড়িতে ওড়িশার দিকে গিয়েছেন।’’ পুলিশ জানিয়েছে, অভিযুক্তকে ধরতে এগরা থানা থেকে পুলিশের একটি দল ওড়িশা গিয়েছে। পূর্ব মেদিনীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (গ্রামীণ) মানবকুমার সিঙ্ঘল বলেন, ‘‘বিস্ফোরক এবং অনিচ্ছাকৃত খুনের আইনে কৃষ্ণপদ বাগ, তাঁর ছেলে ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে পুলিশ মামলা রুজু করেছে। অভিযুক্তদের খোঁজে তল্লাশি চলছে।’’
স্থানীয় মানুষ পুরো পরিস্থিতিতে যথেষ্ট ক্ষুব্ধ। কৃষ্ণপদের ফাঁকা বাড়িতে যে সিভিক ভলান্টিয়ারদের মোতায়েন করা হয়, তাঁদের দু’জনকে এক সময়ে গ্রামের মানুষ বাঁশ উঁচিয়ে তাড়া করেন বলে অভিযোগ। তার পরে দুই মন্ত্রী মানস ভুঁইয়া, বিপ্লব রায়চৌধুরী, সাংসদ দোলা সেন ও বিধায়ক সৌমেন মহাপাত্রেরা গ্রামে পৌঁছলে তাঁরাও বিক্ষোভের মুখে পড়েন। তাঁরা মৃতদের বাড়িতে যান। ফেরার পথে তাঁদের ঘিরে বিক্ষোভ দেখায় একাংশ গ্রামবাসী। ওঠে ‘চোর, চোর’ স্লোগানও। মানসের দাবি, ‘‘রাম-বাম এক হয়ে এটা ঘটিয়েছে।’’ বিজেপি ও সিপিএম কেউই অবশ্য তা মানেনি।
বিরোধী দলনেতা অবশ্য তার ঘণ্টাদুয়েক আগেই গ্রামে ঘুরে এসেছেন। বেলা ১২টা নাগাদ শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে খাদিকুল গ্রামে যান বিজেপি বিধায়ক হিরণ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। বাজি কারখানার ৫০ মিটার দূরে স্থানীয় গৌরীশঙ্কর মাইতির বাড়ির ছাদে উঠে শুভেন্দু বিস্ফোরণ-স্থল দেখেন। পরে গ্রামের একটি শিশুশিক্ষা কেন্দ্রে গিয়ে তিনি মৃত এবং আহতদের পরিজনেদের সঙ্গে কথা বলেন। শুভেন্দু বলেন, ‘‘বগটুই থেকে এগরা— গোটা বাংলা জ্বলছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এক মিনিট মুখ্যমন্ত্রী পদে থাকার অধিকার নেই।’’
তৃণমূল সূত্রের খবর, এ দিনই নেগুয়ায় তৃণমূল কার্যালয় থেকে মৃত এবং জখমদের পরিবারকে রাজ্য সরকারের ঘোষিত আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ছিল। তবে তা হয়নি। এই প্রসঙ্গে শুভেন্দুর দাবি, ‘‘মৃতদের পরিবারকে ন্যূনতম ১০ লক্ষ টাকা করে দিতে হবে।’’ তিনি আরও জানান যে, বিপর্যয় মোকাবিলা দফতর থেকে এই অর্থ দেওয়া হয়, সেই টাকা কেন্দ্র দেয়। তাই তৃণমূল কার্যালয় থেকে নয়, পঞ্চায়েত বা ব্লক অফিস থেকে টাকা দিতে হবে। মন্ত্রী মানস অবশ্য দাবি করেন, ক্ষতিপূরণ বিলি নয়, তাঁরা যান মুখ্যমন্ত্রীর পাশে থাকার বার্তা পৌঁছে দিতে।
পরিবারগুলি সরকারি ক্ষতিপূরণ কবে পাবে? মন্ত্রীর জবাব, ‘‘শীঘ্রই পেয়ে যাবে।’’