এমনই হাল রাজা চা বাগানের হাসপাতালের।—নিজস্ব চিত্র।
গত প্রায় দেড় বছর ধরে ডুয়ার্সের বন্ধ মধু চা বাগানে কোনও চিকিৎসক নেই। কেউ অসুস্থ হলে আলিপুরদুয়ার জেলা হাসপাতালে ছুটতে হচ্ছে। হান্টাপাড়া চা বাগানের শ্রমিক ভোটে দরজি হতাশায় ভুগছেন। তিনি বলেন, “জল নেই। আলো নেই। ওষুধ নেই। চিকিৎসকও নেই। কম্পাউন্ডার রোগী দেখেন। এটাই হাসপাতাল!’’
বাগানের শ্রমিক বীরকান এক্কা জানালেন, সামান্য জ্বর, পেট খারাপ হলেও বাগানের হাসপাতালের ওষুধে রোগ কমে না। মধু বাগানের শ্রমিক সুনীল রোহার, ডিমার রামু থাপাদেরও একই ক্ষোভ। উপরন্তু, বুধবার রাতে ফের তুলসিপাড়া চা বাগানে বিনা চিকিৎসায় প্রেম বরা (৩৫) নামে এক শ্রমিকের মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে।
এটা নতুন কোনও বিষয় নয়। তরাই-ডুয়ার্সের অধিকাংশ বাগানেই চিকিৎসা পরিষেবা বেহাল বলে অভিযোগ। যা কি না আসন্ন বিধানসভা ভোটে হাতিয়ার করতে চাইছে অনেক রাজনৈতিক দলই।
কারণ, নানা সমীক্ষার সুবাদে এখন এটা প্রায় অনেকেরই জানা, চা বাগানের চিকিৎসা পরিষেবা পুরোপুরি বেহাল। যেমন গত সেপ্টেম্বরে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে স্পেশ্যাল অফিসার হর্ষ মান্দার সমীক্ষা চালিয়ে একটি রিপোর্ট তৈরি করেন। তার আগে ২০১৩ সালে রাজ্যের শ্রম বিভাগও সমীক্ষা চালিয়ে প্রায় একই ধরনের তথ্য পায়। দুই রিপোর্টেই বলা হয়েছে, উত্তরবঙ্গে ৫৮ শতাংশ চা-বাগানে শ্রমিকদের চিকিৎসার কোনও ব্যবস্থাই নেই। পানীয় জল সরবরাহের ব্যবস্থা রয়েছে মাত্র ২২ শতাংশ বাগানে। আইন অনুসারে এ সব ন্যূনতম প্রয়োজনের ব্যবস্থাগুলি করার কথা বাগান কর্তৃপক্ষেরই। কিন্তু এ রাজ্যের অন্যতম প্রধান শিল্পের শ্রমিক সংগঠন বা বাগান-মালিক, কোনও তরফেরই আইন মানার আগ্রহ নেই। দু’বছরের ব্যবধানে তৈরি দুটি সমীক্ষায় এ সব তথ্য উঠে এসেছে।
এই বাগানগুলির প্রতিটিই ১৯৫১ সালের প্ল্যান্টেশন লেবার অ্যাক্টের অধীন। এই আইন অনুযায়ী বাগানে স্থায়ী-অস্থায়ী মিলিয়ে কর্মরত প্রায় ৫ লক্ষ শ্রমিকের চিকিত্সার ব্যবস্থা রাখা অবশ্যকর্তব্য। এই দায়িত্ব চা বাগান মালিকের। কিন্তু শ্রম দফতরের সমীক্ষকেরা সরেজমিনে দেখেছেন, ২৭৩টি বাগানের মধ্যে ১৬৬টিতে ‘হাসপাতাল’ নাম দিয়ে বাড়িঘরের অস্তিত্ব দেখানো হলেও তার মধ্যে মাত্র ৭৪টিতে এমবিবিএস ডাক্তার আছেন। কিন্তু এই ১৬৬টি ‘হাসপাতালে’র মধ্যে ১১৬টিতে নার্সের দেখা পাননি সমীক্ষকেরা। রিপোর্টে বলা হয়েছে, পাহাড়ের ৬৪, তরাইয়ের ২০ এবং ডুয়ার্সের ২৩টি অর্থাত্ মোট ১০৭টি বাগানে কোনও হাসপাতালই নেই। অবশ্য ইন্ডিয়ান টি অ্যাসোসিয়েশনের অতিরিক্ত সচিব অরিজিৎ রাহা-র দাবি, “আমাদের সংগঠনের সদস্যদের বাগানে ডাক্তার আছে বলেই জানি।” একই সঙ্গে তিনি এ কথাও বলেন, “অভাব আছে, তা অস্বীকার করছি না”
কিন্তু প্রাথমিক চিকিত্সার ব্যবস্থা?
১৬০টিতে বা আটান্ন শতাংশ বাগানে কোনও প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অস্তিত্ব খুঁজে পাননি সমীক্ষকেরা। কর্তৃপক্ষের তরফে দাবি, বাগানগুলিতে অ্যাম্বুল্যান্স আছে। সমীক্ষকেরা মন্তব্য করেছেন, “সেগুলির বেশিরভাগই অচল।” চা-বাগানগুলিতে কর্মরত শ্রমিকদের স্বাস্থ্যক্ষেত্রে চরম অবহেলা ছড়িয়ে রয়েছে, কর্তৃপক্ষ এ ভাবেই আইন লঙ্ঘন করে চলেছেন, কার্যত এমন মন্তব্যই করেছেন সমীক্ষকেরা। প্রাক্তন শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু বলেন, “আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর চা-বাগানের আসল চেহারাটা কী জানার জন্য এই সমীক্ষা করানোর উদ্যোগ নিয়েছিলাম। রিপোর্ট রীতিমতো উদ্বেগজনক। ত্রিপাক্ষিক আলোচনায় এই সব অভাব-অভিযোগকে কেন্দ্র করেই করতাম।”
বাম আমলের শ্রমমন্ত্রী অনাদি সাহুও মানছেন, তাঁদের সময়েও বাগানে চিকিৎসা পরিষেবার হাল ভাল ছিল না। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের আমলে বাগান বন্ধ হত মানছি। চিকিৎসার ব্যবস্থা দারুণ ভাল ছিল, তা-ও বলছি না। তবে এখনকার মতো এত মৃত্যু হত না।’’
যা শোনার পরে বর্তমান শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটকের দাবি, বাম আমলে বাগানে শ্রমিক-মৃত্যুর হিসেব দেখলে ওঁরাই চমকে যাবেন। তিনি বলেন, ‘‘বামেদেরই খাদ্যমন্ত্রী প্রয়াত কমল গুহ জানিয়েছিলেন, বাগানে এক হাজারেরও বেশি শ্রমিক অনাহারে কাটাচ্ছেন। এখন অনাদিবাবুরা সেই সত্য অস্বীকার করবেন কী করে?’’ তাঁর আরও বক্তব্য, ‘‘বামেরা এখন চা-শ্রমিকদের মৃত্যু নিয়ে মিথ্যা প্রচার করছে। কিন্তু ওদের ৩৪ বছরের শাসনে শ্রমিকদের চিকিত্সার ব্যবস্থা, চাল-গমের ব্যবস্থা ওরা করে যায়নি কেন? আমরা খাবারের ব্যবস্থা করেছি।’’
তা হলে শ্রমিক সংগঠনগুলি করছে কি? ১৭টি শ্রমিক ইউনিয়নের কোঅর্ডিনেশন কমিটির নেতারা জানান, নানা কারণেই পরিস্থিতি জটিল হয়েছে। অভাবটা কেমন তা হাসপাতালের কর্মীর মুখে শোনা যাক। বীরপাড়া এলাকার চা বাগানের হাসপাতালের এক নার্স নিজের মাইনের টাকা থেকে ইমার্জেন্সি লাইট কিনে সন্ধ্যার পরে রোগী দেখেন। প্যারাসিটামল, কাশির সিরাপ জোগাড় করে শ্রমিকদের দেন। এ ভাবে কতদিন চলতে পারে, প্রশ্ন তাঁদেরও।
(সহ প্রতিবেদন: সব্যসাচী ঘোষ, নারায়ণ দে ও রাজকুমার মোদক)