জেলায় জেলায় অফিস আছে। অফিসার আছেন এক বা দু’জন। কিন্তু ওইটুকুই। কাজ চালানোর জন্য ওই অফিসারদের না দেওয়া হয়েছে পর্যাপ্ত লোকলস্কর, না বন্দোবস্ত হয়েছে প্রযুক্তি-পরিকাঠামোর। ফলে নিজঘরে যে-সব মহিলা নিত্য-নির্যাতিত, তাঁদের অভিযোগ শোনা ও বিচার পাইয়ে দেওয়ার জন্য নিযুক্ত প্রটেকশন বা সুরক্ষা অফিসারদের কাজ করতে হচ্ছে নিতান্তই ঢাল-তলোয়ারহীন নিধিরাম অবস্থায়।
অথচ ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো (এনসিআরবি)-র পরিসংখ্যান বলছে, পরিবারে বিবাহিত মহিলাদের উপরে অত্যাচারের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গের স্থান এক নম্বরে। যে-সব মহিলা গার্হস্থ্য ক্ষেত্রে অত্যাচারিত, তাঁদের অভিযোগ নেওয়ার জন্য জেলায় জেলায় অফিসার আছেন ঠিকই। কিন্তু রাজ্য সরকার সেই অফিসারদের জন্য লোকবল বা আধুনিক পরিকাঠামোর ব্যবস্থা না-করায় বিঘ্নিত হচ্ছে নিগৃহীতাদের নিরাপত্তা। ব্যাহত হচ্ছে তাঁদের সুবিচার পাওয়ার সম্ভাবনাও।
রাজ্যের নারী ও সমাজকল্যাণ দফতর সূত্রের খবর, ২০০৬ সালে ‘ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স অ্যাক্ট’ বা গার্হস্থ্য হিংসা প্রতিরোধ আইন চালু হলেও এ রাজ্যে সুরক্ষা অফিসার পদটি চালু হয়েছে ২০০৮-এ। প্রতিটি জেলাতেই এক বা দু’জন করে এই অফিসার নিয়োগ করা হয়। মূলত পারিবারিক জীবনে মহিলাদের উপরে অত্যাচার হলে সেই সব অভিযোগ নথিভুক্ত করা, নির্দিষ্ট ফর্মে তা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পৌঁছনো থেকে শুরু করে অভিযোগকারিণীকে সব দিক থেকে সাহায্য করাই এই অফিসারদের কাজ। অত্যাচারিতার বিচার পাওয়া বা না-পাওয়ার বিষয়টি নির্ভর করে এই অফিসারদের কাজের উপরেই। অথচ সেই কাজ দ্রুত করার জন্য তাঁদের আধুনিক প্রযুক্তি ও পরিকাঠামো দেওয়া হয়নি।
কলকাতা বা দূরের জেলা সর্বত্রই এক অবস্থা। খাস কলকাতায় সুরক্ষা অফিসার দু’জন। কিন্তু তাঁদের সাহায্য করার জন্য কোনও রেজিস্ট্রার বা পিওন নেই। নেই অভিযোগ নথিভুক্ত করার কম্পিউটারও। তাই নিগৃহীতার অভিযোগ শোনা, নির্দিষ্ট ফর্মে তা জেলা স্তরের আইনি পরিষেবা অফিস ও জেলাশাসকের কাছে পাঠানো-সহ সব কাজই হাতে-কলমে করতে হয় দুই সুরক্ষা অফিসারকে। দফতর সূত্রের খবর, কলকাতার এক জন সুরক্ষা অফিসারের কাছে তিন মাসে ৬০-৭০টি অভিযোগ আসে।
কলকাতায় দু’জন সুরক্ষা অফিসার থাকলেও পুরুলিয়ায় আছেন মাত্র এক জন। ফলে অভিযোগ নেওয়া থেকে শুরু করে অভিযোগকারিণীকে বিচার পাইয়ে দেওয়া পর্যন্ত সব কাজই তাঁকে একাকে সামলাতে হয়। তিনি একটি কম্পিউটার পেয়েছেন, কিন্তু তাতে ইন্টারনেট সংযোগ নেই। ফলে হাইকোর্ট বা দেশের অন্য কোনও আদালত নতুন কোনও রায় দিলে তা তাঁর কাছে পৌঁছতে অনেক দেরি হয়ে যায়। হাওড়ায় সুরক্ষা অফিসারের দফতর জেলাশাসকের অফিসের গায়েই। তিনি এক জন সহকারী পেয়েছেন। কিন্তু পরিকাঠামোর সমস্যা সেখানেও প্রকট।
কিন্তু কেন? এই সুরক্ষা অফিসার পদটির কি কোনও গুরুত্ব নেই?
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর ২০১৪ সালের রিপোর্ট উল্টো কথাই বলছে। তাতে দেখা যাচ্ছে: বাংলায় বিবাহিতাদের উপরে অত্যাচার দেশের মধ্যে সব থেকে বেশি তো বটেই। সেই সঙ্গে পণপ্রথার চাপ সহ্য করতে না-পেরে আত্মহত্যার ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ দ্বিতীয় এবং প্রত্যক্ষ ভাবে পণপ্রথার বলির সংখ্যায় চতুর্থ। অর্থাৎ গার্হস্থ্য হিংসার মোকাবিলা যদি করতেই হয়, তা হলে পর্যাপ্ত লোকবল ও পরিকাঠামো নিয়ে এ রাজ্যেই ঝাঁপিয়ে পড়া দরকার। এই পরিস্থিতিতে সুরক্ষা অফিসারদের সাহায্য করার জন্য যথেষ্ট লোক এবং পরিকাঠামো দেওয়া হচ্ছে না কেন?
সরকারি কোষাগারের দুর্দশার জন্যই সুরক্ষা অফিসারদের সহায়ক ‘গ্রুপ-ডি’ কর্মী বা পরিকাঠামোগত উন্নয়নের বন্দোবস্ত করা যাচ্ছে না বলে সমাজকল্যাণ দফতর সূত্রের খবর। দফতরের অধিকর্তা সোমনাথ মুখোপাধ্যায় জানান, তাঁরা লোক দেওয়ার চেষ্টা করছেন। তবে সুরক্ষা অফিসারদের অনেকেরই অনুযোগ, সেই চেষ্টার কোনও প্রতিফলন তাঁরা দেখছেন না। সাত বছর ধরে একই অবস্থা চলছে। তাঁরা জানান, বেতন এতই কম যে, ‘গ্রুপ-ডি’ কর্মীর পদে ইন্টারভিউ দিয়েও অনেকে কাজে যোগ দিচ্ছেন না। পুরুলিয়ায় ওই পদের জন্য দু’বার বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মাত্র তিন হাজার টাকা বেতনে কেউ যোগ দেননি। জেলার এক সুরক্ষা অফিসার জানান, ২০০৮ সালে ওই পদের বিজ্ঞপ্তি জারির সময় প্রত্যেক অফিসারের সঙ্গে অন্তত এক জন ‘গ্রুপ-ডি’ কর্মী নিয়োগের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু ওই পর্যন্তই। কাজের কাজ কিছু হয়নি। অথচ সুরক্ষা অফিসারদের কাজে গাফিলতি হলে ‘ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স আইন’ অনুযায়ী তাঁদের শাস্তি দেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে।
কী বলছেন মন্ত্রী? সুরক্ষা অফিসারদের লোকবল ও পরিকাঠামোর অপ্রতুলতার কথা মেনে নিয়েছেন নারী ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রী শশী পাঁজা। তিনি বলেন, ‘‘আমি বিষয়টি জানি। ওঁদের অফিসের পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য একটি পরিকল্পনা করে অর্থ দফতরের কাছে ইতিমধ্যেই ফাইল পাঠিয়েছি। ওদের অনুমোদনের অপেক্ষায় আছি।’’