এনআইএ-পাহারায় আসছে এনএসজি

শিমুলিয়ার মাদ্রাসায় মাটির নীচে কিছু আছে জানিয়ে দিয়েছে বম্ব স্কোয়াড। একটি সুড়ঙ্গেরও আভাস মিলেছে। যদিও সেখানে কতটা বিপদ অপেক্ষা করছে, তা অজানা। এই পরিস্থিতিতে এনআইএ-র তদন্তকারীদের সুরক্ষা দিতে আজ, বুধবার বর্ধমানের মঙ্গলকোটে ওই মাদ্রাসায় ন্যাশনাল সিকিউরিটি গার্ডের (এনএসজি) আসার কথা। দু’দিন হল শিমুলিয়ায় তদন্তে নেমেছে এনআইএ। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সিআইডি-র বম্ব স্কোয়াডেরা লোকেরা চিরুনি তল্লাশি চালিয়ে রিপোর্ট দেওয়ার পরেই তড়িঘড়ি এনএসজি নামানোর সিদ্ধান্ত হয়।

Advertisement

সৌমেন দত্ত

মঙ্গলকোট শেষ আপডেট: ১৫ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:১৩
Share:

বেলডাঙার পাওয়ার হাউস পাড়ায় ভাড়া নেওয়া শাকিলের বাড়িতে এনআইএ-র দল। ছবি: গৌতম প্রামাণিক

শিমুলিয়ার মাদ্রাসায় মাটির নীচে কিছু আছে জানিয়ে দিয়েছে বম্ব স্কোয়াড। একটি সুড়ঙ্গেরও আভাস মিলেছে। যদিও সেখানে কতটা বিপদ অপেক্ষা করছে, তা অজানা।

Advertisement

এই পরিস্থিতিতে এনআইএ-র তদন্তকারীদের সুরক্ষা দিতে আজ, বুধবার বর্ধমানের মঙ্গলকোটে ওই মাদ্রাসায় ন্যাশনাল সিকিউরিটি গার্ডের (এনএসজি) আসার কথা। দু’দিন হল শিমুলিয়ায় তদন্তে নেমেছে এনআইএ। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সিআইডি-র বম্ব স্কোয়াডেরা লোকেরা চিরুনি তল্লাশি চালিয়ে রিপোর্ট দেওয়ার পরেই তড়িঘড়ি এনএসজি নামানোর সিদ্ধান্ত হয়। এ দিনই ডিআইজি (এনআইএ) অনুরাগ তনখা বর্ধমানে পৌঁছন। তাঁর সঙ্গে সিআরপি-র একটি দলও শিমুলিয়ায় যাচ্ছে।

জঙ্গি মোকাবিলায় বিশেষ ভাবে পারদর্শী এনএসজি-কে সাধারণত দু’টি ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় এক) পণবন্দিদের মুক্ত করা বা দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে শত্রুর ডেরায় হানা দেওয়া। যেমন দেখা গিয়েছিল মুম্বইয়ে ২৬/১১-র জঙ্গি আক্রমণের সময়ে। দুই) কিছু ক্ষেত্রে ভিভিআইপি-দের নিরাপত্তা দিতে। শিমুলিয়ায় এনএসজি-কে পাঠানোর দু’টি কারণই রয়েছে।

Advertisement

সিআইডি সূত্রের খবর, শিমুলিয়ার মাদ্রাসায় যে সুড়ঙ্গের আভাস মিলেছে, তার ভিতরে তল্লাশি চালাতে গেলে বিশেষ প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। তা এনএসজি-রই আছে। সম্ভবত সেই কারণেই বম্ব স্কোয়াডের কাছ থেকে সুড়ঙ্গের কথা শোনা মাত্র এনএসজি কম্যান্ডোদের ডেকে পাঠানো হয়েছে। যদিও এনআইএ-র একটি সূত্রে দাবি করা হয়েছে, তারা এনএসজি-কে ডাকেনি, আবার আসতে বারণও করেনি। কারণ পরিস্থিতি এতটাই গুরুতর যে তদন্ত চালাতে গিয়ে অফিসারেরা আক্রান্ত হতে পারেন, সে সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।

খাগড়াগড় বিস্ফোরণের তদন্তে কেন্দ্রীয় সংস্থা নামার পরেই তদন্তের গতিপ্রকৃতি পাল্টে গিয়েছে। প্রথমটায় পুলিশ যে ঢিলেঢালা মানসিকতা দেখিয়েছে, তাতে কেন্দ্রীয় অফিসারেরা যথেষ্ট বিরক্ত। বিস্ফোরণের দিন তিনেকের মধ্যেই শিমুলিয়া মাদ্রাসার কথা জানতে পেরেছিল বর্ধমান পুলিশ। কিন্তু তারা দ্রুত ব্যবস্থা না নেওয়ায় অনেক মালপত্র সমেত এখানকার লোকজন সরে পড়তে পেরেছে বলে সন্দেহ এনআইএ-র। সন্ধ্যায় কেন্দ্রীয় ফরেন্সিক দল গিয়ে মাদ্রাসার সামনে পড়ে থাকা ন্যানো গাড়িটিও পরীক্ষা করে। ওই গাড়িতেই ইউসুফ ও তার সঙ্গী বোরহান শেখ ঘোরাফেরা করত বলে এলাকার লোকজন গোয়েন্দাদের জানিয়েছেন। গাড়িটির ভিতরে রক্তের দাগ ও কিছু জামাকাপড় মিলেছে।

এ দিন সকাল ১১টা নাগাদ ডিএসপি পদমর্যাদার এক আধিকারিকের নেতৃত্বে এনআইএ-র চার সদস্যের দল শিমুলিয়া পৌঁছয়। সঙ্গে ছিল পুলিশ। বাড়ির পিছনের দিকে মাটি থেকে ফুটখানেক উপরে ছোট-ছোট জানলা। ঘরে খাট নেই। মেঝেয় শুয়ে কথা বললে যাতে বাইরে দাঁড়িয়ে তা শোনা না যায়, সে জন্যই এত নিচু জানলা তৈরি করা হয়েছিল বলে গোয়েন্দাদের অনুমান। এখানে ২০-২৫ জন থাকত বলে জানান তাঁরা। বাড়িটির ভিতরে একটি কুয়োয় তল্লাশি চালিয়েও কিছু মেলেনি।

পালানোর আগে সন্দেহভাজন জঙ্গিরা কিছু মালপত্র ফেলে দিয়ে থাকতে পারে সন্দেহে দুপুর ১২টা নাগাদ মাদ্রাসার পাশের পুকুরে লোক নামানো হয়। তাতে বিশেষ কিছু পাওয়া যায়নি। পাড়ে দাঁড়িয়ে নির্দেশ দিচ্ছিলেন এনআইএ-র অফিসারেরা। তল্লাশি চালিয়েও ডোবা থেকে যখন কিছু মিলছে না, এক অফিসার আক্ষেপ করেন, “এখানে জেহাদের প্রশিক্ষণ চলছিল। তিন-চার দিন সময় পেয়েই পালিয়ে গিয়েছে।” কিন্তু অফিসারদের সন্দেহ যায়নি। পুকুরের মালিককে রাতের মধ্যে সব জল তুলে ফেলতে বলা হয়েছে।

দুপুর দেড়টা নাগাদ মাদ্রাসা থেকে সামান্য দূরে বোরহানের বাড়িতে যায় এনআইএ-র দল। প্রথমে ঢুকতে দিতে চাননি পরিবারের লোকজন। জোর করে দরজা খুলিয়ে ঢোকেন অফিসারেরা। ভিতরে গিয়ে বোরহানের মা, বৌদি ও দিদিমার সঙ্গে কথা বলেন তাঁরা। নানা প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময়ে মা আসুরা বিবি অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে তিনি বলেন, “আমি এক হতভাগী মা। ইউসুফকে মাদ্রাসার জমি দিয়ে আমার ছেলে বড় ভুল করেছে। ইউসুফ ও তার স্ত্রী আয়েষা মাদ্রাসাতেই থাকত। বোরহানের স্ত্রী সাহনওয়াজও ওখানেই থাকত। ঈদুজ্জোহার চার দিন আগে ওরা চলে গিয়েছে।” বোরহানের কাকা সফিকুল শেখকেও ডেকে পাঠিয়ে জমি সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করে এনআইএ।

দুপুর ২টো নাগাদ এনআইএ-র একটি দল খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণস্থলে যায়। সেখানে থাকা সমস্ত নমুনা পুলিশের কাছ থেকে বুঝে নিয়ে রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ বাড়িটি ‘সিল’ করে বেরিয়ে যায় তারা। ওই সব নমুনা কেন্দ্রীয় ফরেন্সিক ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হবে বলে এনআইএ সূত্রে জানা গিয়েছে। বিকেলে মঙ্গলকোট থানায় বসে ঘণ্টা তিনেক ধরে শিমুলিয়া মাদ্রাসার পরিচালক ইউসুফ শেখের মোবাইল ফোনের টাওয়ার লোকেশনের গতিবিধি লক্ষ করেন এনআইএ অফিসারেরা।

এ দিন দুপুরেই মুর্শিদাবাদের বেলডাঙা থানায় আসেন এনআইএ-র তিন গোয়েন্দা। দুপুর সওয়া ১টা নাগাদ তাঁরা বেলডাঙার পাওয়ার হাউস পাড়ার অলিওল ইসলামের বাড়ি যান। অলিওলের এই বাড়িই গত প্রায় তিন বছর ধরে ভাড়া নিয়েছিল খাগড়াগড় বিস্ফোরণে হত শাকিল আহমেদ। এ দিন এনআইএ যাওয়ার আগেই সিআইডি সেখানে গিয়ে অলিওলকে জেরা করে। পরে এনআইএ অফিসারেরা গিয়ে প্রচুর ছবি তোলেন। শাকিল যে ঘরে থাকত, সেখান থেকে তাঁরা দু’টি ব্যাগও উদ্ধার করেছেন। সেই ব্যাগে তুষ ও কিছু লিফলেট (আরবি থেকে বাংলায় অনুবাদ করা) ছিল। লাগোয়া বাড়ির মালিক মুস্তাফিজুর রহমানের স্ত্রী আফিফা বিবি গোয়েন্দাদের জানান, শাকিলের বাড়ির বারান্দা ও ঘর বড় পর্দা দিয়ে সব সময়ে ঢাকা থাকত। কিছুই দেখা যেত না।

সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ বীরভূমের নানুরে পৌঁছয় এনআইএ-র তিন সদস্যের একটি দল। পুলিশের সঙ্গে তাদের বৈঠক চলার সময়েই সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা নাগাদ এসআইবি-র দুই অফিসার এসে পৌঁছন। রাত ৮টা নাগাদ এনআইএ-র দলটি বেরিয়ে বোলপুরের দিকে রওনা দেয়। পুলিশ সূত্রের খবর, গত শনিবার কদর গাজির বাড়ি থেকে উদ্ধার হওয়া পোড়া কাগজপত্র, ডায়েরি-সহ বাজেয়াপ্ত করা জিনিসপত্র তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। এসডিপিও (বোলপুর) সূর্যপ্রতাপ যাদবের কাছে তারা জেনারেটর, বাংলা জানা লোক আর পুলিশ বাহিনী চেয়েছে। রাতে উত্তরবঙ্গেও পৌঁছয় এনআইএ-র একটি দল। ধূপগুড়ি ও জয়গাঁয় তাদের যাওয়ার কথা বলে পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে।

অন্য দিকে, নদিয়ার করিমপুর এলাকাতেও এক গ্রামীণ চিকিৎসকের খোঁজ শুরু করেছে সিআইডি। থানারপাড়াতেও তার খোঁজে হানা দেওয়া হয়। সিআইডি-র দাবি, ওই গ্রামীণ চিকিৎসকের সন্ধান পেলেই খাগড়াগড় বিস্ফোরণ সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে আসবে। এনআইএ-র তদন্তকারীদের কাছে ওই গ্রামীণ চিকিৎসকের নাম উঠে এসেছিল। তারাই সিআইডি-কে ওই চিকিৎসকের খোঁজ করতে বলেছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement