ছবি পিটিআই।
ভয় বড় সংক্রামক!
আর সেই সংক্রমণই ছড়িয়ে পড়ছে মুর্শিদাবাদের আনাচকানাচে। ইতিমধ্যে উৎকণ্ঠা ও ভয়ে ডোমকলের এক যুবক আত্মঘাতী হয়েছেন। নিজের ভিটের পুরনো দলিলপত্র জোগাড় করতে না পেরে দিন কয়েক ধরে প্রবল দুশ্চিন্তায় ভুগে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন মাঝবয়সি এক ব্যক্তিও। ‘অ্যাংজ়াইটি ডিসঅর্ডার’ থেকে রেহাই পেতে প্রান্তিক মানুষজন এখন ভিড় করছেন মনোবিদের কাছে।
ভয়ের নাম এনআরসি। এ রাজ্যে তা এখনও চালু না হলেও এনআরসি-ছায়ায় কুঁকড়ে রয়েছে নবাবের জেলা। ডোমকলের শিবনগর গ্রামের আত্মঘাতী যুবক মিলন মণ্ডলের (২৭) বাবা দিস্তার মণ্ডল বলছেন, ‘‘কেরলে কাজ করত ছেলে। ঘরে ফিরে ভোটার আর আধার কার্ডে নামের ভুল বানান আর ঠিকানার গন্ডগোল দেখে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছিল। সপ্তাহ দুয়েক ধরে সারা দিন বিডিও অফিসে তদ্বির করে বেড়াত। ভুল সংশোধন করাতে না-পেরে ছেলেটা মনমরা হয়ে গিয়েছিল।’’
মিলনের স্ত্রী রেণুকা বলছেন, ‘‘খালি বিড়বিড় করত, ভিটেমাটি-পরিবার সব উচ্ছেদ হবে। সে সবের আগে ও নিজেই শেষ হয়ে গেল।’’ মিলনের মা আদরা বিবিই ছেলের ঝুলন্ত দেহ দেখতে পান। স্থানীয় গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য তৃণমূলের জুলেখা বিবির দাবি, ‘‘শুধু মিলন নয়, গ্রামের বেশির ভাগ মানুষই নাগরিক পঞ্জির আতঙ্কে ভুগছেন।’’
হরিহরপাড়ার সলুয়া গ্রামের গিয়াসউদ্দিন শেখও সেই তীব্র মানসিক চাপ থেকেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন বলে তাঁর বাড়ির লোকের দাবি। বস্তুত মনের অসুখ এখন সীমান্তের এই জেলায় দ্রুত ছড়াচ্ছে। ডোমকলের হসপিটাল মোড়ের কাছে চেম্বার মনোবিদ সেলিম মালিকের। তিনি বলছেন, ‘‘এ তো গণ-ভয়! এটাকে বলা হয় অ্যাংজ়াইটি ডিসঅর্ডার। ভয় ছড়ালে গ্রামের পর গ্রাম তাতে আক্রান্ত হয়। তীব্র ভয় অনেককে আত্মহননের দিকেও ঠেলে দিতে পারে।’’
ডোমকলের বিডিও পার্থ মণ্ডলেরও পর্যবেক্ষণ তা-ই। তিনি বলছেন, ‘‘এনআরসি’র ভয় যেন গণ-হিস্টিরিয়ার চেহারা নিচ্ছে! আমরা প্রতিটি পঞ্চায়েত প্রধান, এমনকি স্কুল শিক্ষকদেরও বলেছি, বিভ্রান্তি কাটাতে মানুষকে বোঝান, অভয় দিন।’’ এনআরসি আতঙ্ক কাটাতে ইমাম ও মোয়াজ্জিনদের নিয়ে প্রচারের কথাও ভেবেছে জেলা প্রশাসন। সম্প্রতি বেলডাঙা ১ ব্লক দফতরে ৩৫ জন ইমাম-মোয়াজ্জিনকে নিয়ে সভাও করেছেন কর্তারা। সেখানে তাঁদের জানানো হয়েছে, সরকারি নির্দেশ মেনে রেশন কার্ড ও ভোটার কার্ড সংশোধনের কাজ চলছে। এর সঙ্গে এনআরসি-র কোনও সম্পর্ক নেই।
বিডিও বিরূপাক্ষ মিত্র বলেন, “আপনারা জুম্মাবারে মসজিদে আসা মানুষদের বোঝান। এনআরসি নিয়ে গুজবে যেন তাঁরা কান না দেন।”
শুধু মসজিদ নয়, প্রয়োজনে ইমামদের গ্রামে নিয়ে গিয়েও প্রচার করানো হবে বলে জানান জেলার এক শীর্ষ কর্তা। গোদের উপর বিষফোড়া হয়েছে, মানুষের উদ্বেগকে অস্ত্র করে লোক ঠকানোর কারবার! গ্রামবাসীদের হাতে ভুয়ো কার্ড তুলে দেওয়ার অভিযোগও অহরহ আসছে জেলা প্রশাসনের কাছে। ইতিমধ্যে জাল ভোটার ও আধার কার্ড তৈরির অভিযোগে বেশ কয়েক জন ধরাও পড়েছে।
যাদের এক জন কবুলও করেছে, ‘‘দু’টি কম্পিউটার কিনে ব্যবসা শুরু করেছিলাম। কিন্তু গাঁ-গঞ্জে কি তা চলে? মাছি তাড়িয়ে হাতে ব্যথা হয়ে গিয়েছিল। এনআরসি-র ভয় রুজির দরজা খুলে দিল।’’ ডোমকল, রানিনগর, জলঙ্গি, জঙ্গিপুরের অনেকেই বলছেন, ‘‘এমন কারবার ফেঁদে বসেছে অনেকেই। এই বিপদের সময় তারাও দু’পয়সা বাড়তি আয় করছে।’’ জেলাশাসক জগদীশ প্রসাদ মিনা বলছেন, ‘‘ভোটার, আধার ও রেশন কার্ড সরকারি ভাবেই করা হয়। এ ব্যাপারে আমরা সচেতন করছি।’’
উল্টো ছবিও রয়েছে। ডোমকলের বিলাসপুরের জনা কয়েক যুবক গত কয়েক দিন ধরে গ্রামের লোকজনের কাছে হয়ে উঠেছেন মুশকিল আসান। নথিপত্রে কোথায় ভুল আছে সেটা দেখে, ভরে দিচ্ছেন ফর্মও। তাঁদের এক জন, প্রাথমিক শিক্ষক আলমগীর হোসেন বলছেন, ‘‘এনআরসি নিয়ে যা চলছে তা তো বুঝতেই পারছেন। লোকজন বড় দুশ্চিন্তায়। এখন পাশে না দাঁড়ালে চলে?’’ কিন্তু এই গণ-ভয় থেকে মুক্তির উপায় কী? জেলাশাসক বলছেন, ‘‘ভোটার তথ্য যাচাই বা রেশন কার্ডের আবেদনের সঙ্গে নাগরিক পঞ্জি বা ডি-ভোটারের সম্পর্ক নেই। আমরা ব্লকে ব্লকে প্রচারও করছি।’’ শুনে টেঁয়া রামপুরের আসরফ আলি বলছেন, ‘‘সাত পুরুষের ভিটে ছাড়ার ভয় কি আর মুখের কথায় কাটে বাবু!’’