মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফাইল চিত্র।
অসমে নাগরিক পঞ্জীকরণ (এনআরসি) তালিকা থেকে নাম বাদ দিয়ে রাতারাতি ৪০ লক্ষ মানুষকে ‘উদ্বাস্তু’ বানিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘বাঙালি খেদাও, বিহারি খেদাও’-এর হিড়িক চলছে বলেও দাবি করেছেন তিনি। কিন্তু এনআরসি কর্তৃপক্ষের একটি সূত্রের দাবি, যাচাইয়ের জন্য প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজার মানুষের তথ্যপঞ্জি পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু সেই কাজের খুব সামান্য অংশই সম্পূর্ণ করেছে তারা। যাচাই না-হওয়া সেই নামগুলো তালিকার বাইরেই থেকে গিয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রী নিজে এখন দিল্লিতে রয়েছেন। এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে মমতা দাবি করেন, ‘‘সর্বৈব মিথ্যা কথা। আমাদের কাছে কিছুই চাওয়া হয়নি।’’ কিন্তু এনআরসি কর্তৃপক্ষের দাবি, তাঁরা শুধু নথি পাঠানইনি, পাঠানো নথির মধ্যে ১৫ হাজার নথি যাচাই হয়ে ফেরতও এসেছে। সে কথা উল্লেখ করা হলে মমতা বলেন, ‘‘এ রকম কিছু হলে আমি জানতাম।’’
এনআরসি কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, প্রথম তালিকা প্রকাশের সময় পশ্চিমবঙ্গ থেকে মাত্র হাজার সাতেক নথি ফেরত এসেছিল। চূড়ান্ত খসড়া তালিকা প্রকাশের সময় সংখ্যাটা পৌঁছয় ১৫ হাজারে। এনআরসি-র দাবি, বারবার পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে বিষয়টি জানানো হয়েছে। কিন্তু তারা গুরুত্ব না দেওয়ার ফলেই ১ লক্ষ ৫ হাজার নথি যাচাই করা যায়নি।
এনআরসি-র কাছ থেকে নথি আসার কথা স্বীকার করছে এ রাজ্যের জেলা প্রশাসনের একাধিক সূত্রও। কিন্তু এত কম নথি যাচাইয়ের কারণ কী? সে প্রসঙ্গে প্রশাসন সূত্রের দাবি, ২০১৫ সালে এই কাজ শুরু হয়। গোড়ার দিকে লোকাভাব ছিল প্রবল। এনআরসি কর্তৃপক্ষ এবং কেন্দ্রীয় সরকারও গা লাগায়নি। সেই কারণে বিষয়টি তখন অগ্রাধিকার পায়নি। পদ্ধতিগত জটিলতাও ছিল। রাজ্যের প্রাক্তন আমলারাও অনেকেই বলছেন, এনআরসি-কে এখন যে ভাবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, শুরু থেকে তা দেওয়া হলে পরিস্থিতি অন্য রকম হতে পারত।
অসমে বসবাসকারী কোনও ব্যক্তির অতীত জানতে আগে তিনি যে রাজ্যে ছিলেন, সেখানে তাঁর নথি যাচাইয়ের জন্য পাঠিয়েছেন এনআরসি কর্তৃপক্ষ। অতীতে পশ্চিমবঙ্গ-নিবাসী হলে সেই নথি পশ্চিমবঙ্গের হাতে আসে। প্রশাসন সূত্রের খবর, রাজ্য সরকারের তরফে এনআরসি-র কাছ থেকে ওই নথি গ্রহণ করে স্বরাষ্ট্র দফতর। তার পরে সেই নথি যাচাইয়ের জন্য যায় সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসনের কাছে। চলতি বছরের গোড়ায় সব রাজ্যের সঙ্গেই ভিডিয়ো কনফারেন্স করেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্তারা। প্রশাসনের দাবি, তখন লোকবল চাইলে ‘ডিরেক্টরেট সেন্সাস অপারেশনস’-এর কয়েক জন অফিসারকে কাজে লাগানোর অনুমতি দেয় কেন্দ্র। তার পর থেকে নথি যাচাইয়ের কাজে গতি বাড়ে।
এতৎসত্ত্বেও জেলার প্রশাসনিক কর্তাদের অনেকেই বলছেন, প্রক্রিয়াটা খুবই সময়সাপেক্ষ। অনেক ক্ষেত্রেই ১৯৫০-’৬০ সালের নথি খুঁজে পাওয়া যায় না। ১৯৭১-এর আগে যাঁরা এ দেশে এসেছেন, তাঁদের সীমান্ত পেরোনোর নথিও বহু ক্ষেত্রে নেই। বিপর্যয়ে অনেক নথি নষ্ট হয়, সমস্যা বাড়ে। যেমন, উত্তরবঙ্গের এক জেলার সরকারি কার্যালয়ে অগ্নিকাণ্ডে বহু নথি নষ্ট হয়। সংশ্লিষ্ট জেলাশাসকের তরফে সেই রিপোর্ট এনআরসি-কে পাঠানোও হয়। প্রশাসনের অন্দরেই প্রশ্ন, নথি নষ্ট হলে নাগরিক কেন তার খেসারত দেবে! কয়েক দিনের মধ্যে কেন্দ্রের কাছে এ নিয়ে লিখিত আর্জি জানানোর চিন্তাভাবনা রয়েছে।
‘বেঙ্গল রেকর্ডস ম্যানুয়াল-১৯৪৩’ অনুযায়ী, তিন ধরনের সরকারি নথির সংরক্ষণ পদ্ধতি পৃথক। যেমন, জমি সংক্রান্ত নথিগুলি চিরকালের জন্য সংরক্ষণ করতে হয়। কিছু নথি ১২ বছর পর্যন্ত সংরক্ষণ করা বাধ্যতামূলক। কিছু নথি দু’বছর পরেই নষ্ট করে ফেলা যায়। আমলাদের একাংশের ব্যাখ্যা, অভিবাসন সংক্রান্ত নথি ১২ বছর পর্যন্তই সংরক্ষণ করা হয়। মধ্যশিক্ষা পর্ষদ বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলি থেকে তথ্য যাচাইয়ে সমস্যা নেই। সব ক্ষেত্রে সেই জাতীয় নথি না থাকায় যাচাইয়ের কাজ ধাক্কা খাচ্ছে।