পুরনো সেই দিনের... মহাকরণের ক্যান্টিনে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে একাসনে বসে খাওয়া। পাশে কুণাল ঘোষ। উল্টো দিকে মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় ও মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। ২০১৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি নিজের ফেসবুক পেজে ছবিটি পোস্ট করে শিবাজি পাঁজা (একেবারে ডান দিকে) লিখেছিলেন, “আমার জীবনের অন্যতম স্মরণীয় ভূরিভোজ!”
সাধারণের চোখে তিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর ‘অতি কাছের মানুষ’। ব্যবসায়ী হলেও ক্ষমতার অলিন্দে অবাধ গতায়াত। নবান্নে চোদ্দো তলার ঘরে হোক বা মুখ্যমন্ত্রীর গাড়ির পিছনের আসন তাঁর জায়গা প্রায় বাঁধা। শিলিগুড়ি হোক বা সিঙ্গাপুর, মমতার সফরে তিনি সঙ্গে নেই সাম্প্রতিক কালে এমন খুব একটা ঘটেনি। সদ্য বাংলাদেশ সফরেও মুখ্যমন্ত্রীর সফরসঙ্গী আরও অনেকের মতো তাঁর বিমানের টিকিটও কেটেছিল সরকারই।
আর্থিক জালিয়াতির অভিযোগে কলকাতা বিমানবন্দরে অভিবাসন দফতরের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পরে এ হেন শিবাজি পাঁজাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চোখে হয়ে গেলেন নিছক এক জন ‘ব্যবসায়ী’! ব্যবসায়ীর সঙ্গে অন্য কোনও ব্যবসায়ীর কী সমস্যা হয়েছে, ব্যবসার কাজে কে কী করেছেন, সে সবের সঙ্গে নিজেকে জড়াতে রাজি নন মুখ্যমন্ত্রী। বাংলাদেশ-ফেরত মুখ্যমন্ত্রী রবিবার দৃশ্যতই ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে শিবাজির সঙ্গে দূরত্ব বোঝাতে উদ্যত হলেন। ঠিক যেমন সারদা-কাণ্ডে নাম জড়ানোর পরে শিল্পী শুভাপ্রসন্ন মুখ্যমন্ত্রীর চোখে হয়ে উঠেছিলেন ‘ব্যবসায়ী’! মুখ্যমন্ত্রীর ঝোলা ব্যাগ সময়ে-অসময়ে নিজের কাঁধে বয়ে দিয়েছেন যে শিবাজি, বিতর্কের মুহূর্তে ‘ব্যবসায়ী’ তকমায় তাঁর দায় নিজের কাঁধে নিতে চাইলেন না মমতা! তাঁর নিজস্ব কায়দায়। শিবাজি গ্রেফতার হওয়ার পরে মুখ্যমন্ত্রী তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলে বুঝিয়ে দিয়েছেন, এই ধরনের মানুষজন তাঁর বিশেষ পছন্দেরও নয়!
কিন্তু রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষ স্তরের আমলা বা শাসক দলের শীর্ষ নেতাদের কাছে শিবাজি মানে মুখ্যমন্ত্রীরই কাছের মানুষ! তাই প্রশাসনিক মহলে তাঁর বাড়তি গুরুত্ব। তাই লালবাজারের কাছে ওই ‘ব্যবসায়ী’র একটি সংস্থার দফতরে আর্থিক কেলেঙ্কারি সংক্রান্ত বিভাগ তল্লাশি চালাতে গেলে খোদ মুখ্যমন্ত্রীর দফতর থেকেই নাকি ফোন আসে তদন্তকারী অফিসারের কাছে। তল্লাশির কাজ মুলতুবি রেখেই ফিরে যেতে হয় তদন্তকারী দলকে।
এমন প্রভাবশালী মানুষ যদি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বিদেশ সফর থেকে ফেরার পথে গ্রেফতার হন, প্রশ্ন উঠবেই। এ ক্ষেত্রেও বিরোধীরা যেমন তুলেছে। প্রদেশ কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নানের কথায়, “মুখ্যমন্ত্রী সুদীপ্ত সেনের বেলাতেও বলেছিলেন, জানতাম না! মুখ্যমন্ত্রী এবং পুলিশমন্ত্রীর চারপাশে যাঁরা ঘুরে বেড়ান, তাঁদের সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না?” সিপিএম সাংসদ ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য, “বাংলাদেশে গিয়ে এক সফরসঙ্গী সে দেশের জাতীয় সঙ্গীত মাঝখান থেকে গেয়ে লজ্জায় মাথা হেঁট করে দিলেন। আর এক জন ফেরার পথে জালিয়াতির অভিযোগে ধরা পড়লেন। মুখ্যমন্ত্রী কাদের সঙ্গ পছন্দ করছেন, দেখাই যাচ্ছে!” বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের কটাক্ষ, “সিঙ্গাপুরে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে এক কয়লা-মাফিয়া ছিলেন! বাংলাদেশ সফরে তাঁর আর এক সঙ্গী চিটিংবাজিতে ধরা পড়ছে!”
বিরোধীদের আক্রমণের মুখে অবশ্যই প্রবল অস্বস্তিতে শাসক দল। বিড়ম্বনা সামাল দিতে তাদের ঢাল আপাতত একটাই খাতায়-কলমে শিবাজি তৃণমূলের কেউ নন। শিবাজির সম্পাদিত ‘সংগ্রামী মা-মাটি-মানুষ’ তৃণমূলের কাগজ বলেই পরিচিত। কিন্তু তৃণমূলের মুখপত্র হিসেবে তার স্বীকৃতি নেই। শাসক দলের নেতাদের মতে, তৃণমূলের প্রশস্তিসূচক ওই সাপ্তাহিকের সম্পাদক শিবাজি। যেখানে নিয়মিত কলম থাকে মুখ্যমন্ত্রীরও!
আনুষ্ঠানিক ভাবে তৃণমূল না হওয়ার এই ফাঁকটুকু কাজে লাগিয়ে দলনেত্রীর সুরেই দলের জাতীয় মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েন এ দিন বলেছেন, “শিবাজি তৃণমূলের সদস্য নন। একজন ব্যবসায়ী, যিনি বাংলাদেশ সফরে প্রতিনিধি দলে ছিলেন। আইন আইনের পথেই চলবে।” ডেরেকের আরও মন্তব্য, “তবে গ্রেফতারের সময়টা একটা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রীর সফল সফরকে খাটো করার চেষ্টা নয় তো এটা?”
মুখ্যমন্ত্রীর কৃতিত্ব খাটো করার জন্য বিনা কারণে শিবাজিকে ধরা হয়েছে কি না, তার কোনও ব্যাখ্যা তৃণমূল নেতৃত্বের তরফে মেলেনি। মমতার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতার শুরু দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের আমলে, তৃণমূল নেত্রী রেলমন্ত্রী থাকাকালীন। তখন শিবাজি একটি সংবাদমাধ্যম এবং কম্পিউটার সংস্থার অন্যতম কর্ণধার ছিলেন। তার আগে পর্যন্ত শিবাজির ব্যবসায়ী বন্ধুর সিপিএম-ঘনিষ্ঠতার কারণে তাঁদের সংস্থা বামফ্রন্ট সরকারের ঘনিষ্ঠ ছিল। কিন্তু ক্ষমতার বৃত্তে শিবাজির যোগাযোগ শুরু রেলমন্ত্রী মমতার আমলে। তাঁদের সংবাদ চ্যানেলে মমতার পক্ষে ‘ইতিবাচক’ খবর করে দ্রুত তাঁর আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন তিনি। অভিযোগ, সে সময় রেলের বহু বরাতও পান তিনি। ২০১১-র বিধানসভা ভোটের আগে মমতার ‘ব্যাকরুম বয়’ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে ফেলেন শিবাজি। এমনকী, মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে মমতার রাজভবন থেকে মহাকরণ আসার সময়ে তাঁর সঙ্গীও ছিলেন তিনি। গত বছর লোকসভা নির্বাচনে মমতার দলের ‘তারকা প্রচারকে’র তালিকায় অন্যতম এই শিবাজি!
সরকারের অন্দর মহলের জনশ্রুতি, কিছু কিছু ক্ষেত্রে শিবাজির পছন্দ-অপছন্দের উপরে নির্ভর করে অনেক আমলা-অফিসারকে বদলিও হতে হয়েছে। মমতার সঙ্গে শিবাজির এই ঘনিষ্ঠতার কারণে আমলাদের একাংশ তাঁকে প্রায় এড়িয়ে চলেন। অনেকে আবার নিজেদের জায়গা ঠিক রাখতে তাঁকে তোয়াজ করেও চলেন! তথ্য-সংস্কৃতি থেকে শুরু করে নানা দফতরে তাঁর অবাধ বিচরণ। খাতায়-কলমে তিনি তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের টাস্ক ফোর্স-সহ, টেলি অ্যাকাডেমি এবং চলচ্চিত্র সংক্রান্ত কমিটিতে রয়েছেন। সরকারি নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও উৎসবের তিনি অন্যতম কুশীলব। বিশেষ করে, রাজ্যের পালাবদলের পরে মমতার পছন্দের কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের অন্যতম প্রাণপুরুষও শিবাজি! টলিউড ও টেলিউডের সঙ্গে মমতার অন্যতম যোগসূত্র তিনি। আবার সেই সূত্রেই মমতার আর এক সেতু শ্রীকান্ত মোহতার সঙ্গে আজকাল একসঙ্গে উচ্চারিত হয় শিবাজির নাম!
মুখ্যমন্ত্রী কোনও সফরে শহরের বাইরে গেলে তাঁর নিরাপত্তার ঘেরাটোপের মধ্যেই থাকার ব্যবস্থা হয় শিবাজির। তাবড় মন্ত্রী-আমলাকে টপকে সিঙ্গাপুর থেকে ঢাকা সর্বত্রই তিনি মুখ্যমন্ত্রীর এক্কেবারে কাছেই! মুখ্যমন্ত্রীর আই ফোন থেকে ল্যাপটপ, ট্যাব সবই যে দেখভাল করেন শিবাজি! এমনকী, সে সবের কোনও সমস্যা হলে শিবাজিই এক এবং একমাত্র ‘ক্রাইসিস ম্যানেজার’! মুখ্যমন্ত্রী একমাত্র শিবাজিকে ভরসা করেন তাঁর ছবির দেখভাল এবং প্রদর্শনীর ব্যাপারেও। মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মহলে এর আগে এক বার পার্ক স্ট্রিটের এক রেস্তোরাঁয় মারপিটে জড়িয়ে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন শিবাজি। আর এক বার তাঁর চ্যানেল এবং কম্পিউটার সংস্থার ব্যবসায়িক বিবাদের কারণে মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ বৃত্তের বাইরে চলে গিয়েছিলেন তিনি। দু’বারই অল্প সময়ের মধ্যে ফিরে আসেন পুরনো কক্ষপথে! তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতা বলছেন, “এ বারও না আঁচালে বিশ্বাস নেই!”