লন্ডনের রাস্তাতেও হাওয়াই চপ্পলেই প্রাতর্ভ্রমণ মুখ্যমন্ত্রীর।
সামনাসামনি দেখা হল না বলে দুঃখ প্রকাশ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠি লিখলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন।
বছর দুয়েক আগে নিজে কলকাতায় গিয়ে মমতার সঙ্গে দেখা করেছিলেন ক্যামেরন। সে বারই তিনি লন্ডনে আসার জন্য মমতাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে আসেন। কিন্তু ঘটনাচক্রে মমতা যখন লন্ডনে এসেছেন, সে সময় ক্যামেরন জরুরি কাজে দেশের বাইরে। তাই মমতাকে আজ চিঠি পাঠিয়ে দুঃখপ্রকাশ করে ক্যামেরন বললেন, ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে মন্ত্রী প্রীতি পটেল মমতার সঙ্গে কথাবার্তা বলবেন। চিঠিতে লিখলেন, ‘আপনার এই সফরে দু’দেশের মধ্যে কুড়িটিরও বেশি মউ স্বাক্ষরিত হবে। এর ফলে ইতিবাচক উদ্যোগের একটা উজ্জ্বল ছবি ফুটে উঠবে।’ এ বছরের শেষে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে যে তিনি ব্রিটেনে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, সে কথাও চিঠিতে উল্লেখ করেছেন ক্যামেরন। নিজের আঁকা একটি ছবি মমতা নিয়ে এসেছিলেন ক্যামেরনের জন্য। চিঠি পড়ে দৃশ্যতই খুশি মমতা সোমবার বলেন, ‘‘ক্যামেরন এই সফর নিয়ে কতটা আন্তরিক, সেটা এই চিঠির ভেতর দিয়েই বোঝা যায়।’’
আজই বাকিংহাম প্রাসাদে মমতাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন ডিউক অব ইয়র্ক, রাজকুমার অ্যান্ড্রু। একটি ছোট গাড়িতে, চিরাচরিত হাওয়াই চপ্পল পরেই মমতা সেখানে পৌঁছন। অ্যান্ড্রুর সঙ্গে তাঁর ঘণ্টাখানেক বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে অ্যান্ড্রু পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান আর্থ-সামাজিক সমস্যা, রাজস্ব আদায় সমেত প্রশাসনিক নানা খুঁটিনাটি সম্পর্কে জানতে চান। মমতা নিজেই পরে বলেন, তাঁর কাজের ধরন ও তাঁর নেতৃত্বের প্রশংসা করেছেন অ্যান্ড্রু। বলেছেন, ‘‘ইউ আর ভেরি ডায়নামিক!’’ মমতার সঙ্গে তাঁর একান্ত বৈঠকের পরে দু’তরফে আরও কথাবার্তা হয়। হাউস অব লর্ডসের স্পিকার-সহ ব্রিটিশ সরকারের কয়েক জন প্রতিনিধি সেখানে ছিলেন। আর মমতার সঙ্গে ছিলেন রাজ্যের মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র, শিল্পপতি সঞ্জীব গোয়েন্কা, অভিনেতা-সাংসদ দেব প্রমুখ। রাজকুমারকে নিজের আঁকা ছবি উপহার দেন মমতা। রাজপরিবারের শিশুদের জন্য ছিল কলকাতা থেকে আনা জামাকাপড়। অ্যান্ড্রু একটি ছবি ও স্কার্ফ উপহার দেন মমতাকে। মমতার সম্মানে রাজপ্রাসাদে একটি চা-চক্রের আয়োজন ছিল। পরে মুখ্যমন্ত্রীকে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দেন রাজকুমার। যে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে অ্যান্ড্রু যুক্ত, কলকাতাতে তাদের কিছু কাজকর্ম আছে। মমতা কলকাতায় আসার জন্য অ্যান্ড্রুকে আমন্ত্রণও জানিয়েছেন। প্রাসাদের আতিথেয়তায় মুগ্ধ মমতা তাঁকে বলেছেন, ‘‘বাইরে থেকে বাকিংহাম প্রাসাদ দেখেছি। ছবিতেও দেখেছি। কিন্তু রাজপ্রাসাদের আমন্ত্রণে এখানে আসতে পেরে খুব ভাল লাগছে।’’
আলাপচারিতা। রাজকুমার অ্যান্ড্রুর সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাকিংহাম প্রাসাদে।
সফরের প্রথম দিনটা অবশ্য শুরুই হয়েছিল ভাল আমেজে। সকালে ঘুম থেকে উঠে সেন্ট জেমস কোর্ট হোটেলের ঘর থেকে লন্ডনের রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। বাকিংহাম গেট থেকে বাকিংহাম প্লেস, ভিক্টোরিয়া স্ট্রিট— এ গলি-ও গলি, এ রাস্তা-ও রাস্তা হনহনিয়ে হন্টন। লন্ডনের শীতল আবহাওয়ায় ঘাম না ঝরলেও মিনিট চল্লিশেক হেঁটে আসার পরে মমতা হিসেব কষে বলেন, ‘‘সকালেই ৬ কিলেমিটার হয়ে গেল।’’ নিরাপত্তার বাড়াবাড়ি চিরকালই মমতার না-পসন্দ। ফলে লন্ডনের রাস্তায় তিনি খুবই স্বচ্ছন্দ বোধ করছিলেন। সাদা পোশাকের নিজস্ব দুই নিরাপত্তা অফিসার ছাড়া হাঁটার দলে বাকি সকলেই তাঁর পরিচিত জন। হাঁটতে হাঁটতে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল লন্ডন প্রবাসী কয়েক জন ভারতীয়ের। তাঁদের কেউ গুজরাতের, কেউ বা হায়দরাবাদের। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হাতের নাগালে পেয়ে তাঁরা এগিয়ে এলেন শুভেচ্ছা বিনিময় করতে।
হোটেলের কাছেই সুসজ্জিত সেন্ট জেমস পার্কে চক্কর কেটে হাঁস-পায়রা দেখে মুখ্যমন্ত্রী খুব খুশি, ‘‘কী সুন্দর সাজিয়ে করেছে এরা!’’ লন্ডন শহরে রাস্তাঘাটের পরিচ্ছন্নতাও তাঁর চোখ এড়ায়নি। বলে উঠেছেন, আসলে এটা তো কলকাতার মতো ঘিঞ্জি শহর নয়। নিম্নবিত্ত মানুষের সংখ্যাও কম। তাই এদের পক্ষে পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখাও সহজ। মমতার সফরসঙ্গী মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় অবশ্য সেই মুহূর্তে সেখানে ছিলেন না। থাকলে শুনতে পেতেন, মমতা এ-ও বলেছেন, ‘‘আমাদের কলকাতাও যে পরিচ্ছন্ন সুন্দর শহর হয়ে উঠছে এতে কোনও ভুল নেই।’’
ভিক্টোরিয়া স্ট্রিটে সার সার দোকানে চলছে বেচাকেনা। সেখানেও খানিক ক্ষণ দাঁড়ান মুখ্যমন্ত্রী। তার পর হালকা রসিকতায় বলেন, ‘‘আমাদের নিউমার্কেটেও এমন অনেক কিছু পাওয়া যায়।’’ হাঁটার পরে সেন্ট জেমস কোর্টের ঠিক উল্টো দিকে একটি কফি শপে সকলকে নিয়ে খানিক ক্ষণ আড্ডাও চলল। সেখানেই যোগ দিলেন অর্থ ও শিল্পমন্ত্রী অমিত মিত্র এবং কয়েক জন শিল্পোদ্যোগী। বিকেলে ফরেন অ্যান্ড কমনওয়েলথ অফিসে ব্রিটেনের কর্মসংস্থান সংক্রান্ত প্রতিমন্ত্রী প্রীতি পটেলের সঙ্গে বৈঠক হল মমতার। পরে এখানকারই লোকার্নো স্যুইটে দু’দেশের বাণিজ্য প্রতিনিধিদের সামনে ভাষণ দেন তিনি। সেখানেও প্রীতি উপস্থিত ছিলেন। মমতা তাঁদের সকলকে বলেন, ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসানের পরে বাংলার উন্নয়নের কাজ শুরু করেছেন তিনি। শিক্ষা-স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়েছে, কন্যাশ্রী প্রকল্প চালু হয়েছে। গড়ে তোলা হয়েছে জমি ব্যাঙ্ক। নিজেকে শিল্পবান্ধব বলে দাবি করে মমতা বলেছেন, রাজ্যে শিল্পের জন্য কী কী দরকার, সেটা তাঁর সঙ্গে আসা শিল্পোদ্যোগীদের সঙ্গে কথা বললেই জানা যাবে। তবে মুখ্যমন্ত্রীর দৃঢ় বিশ্বাস, সস্তা এবং দক্ষ শ্রমিকের অভাব রাজ্যে নেই। ফলে পর্যটন, পরিষেবা বা উৎপাদন শিল্পে লগ্নি করলে ঠকবেন না কেউ। ব্রিটেনের সঙ্গে বাংলার দীর্ঘ সম্পর্কের কথা মনে করিয়ে দিয়ে হাল্কা সুরে মমতার মন্তব্য, ‘‘ইয়োর ডেস্টিনি ইজ বেঙ্গল! ইয়োর ডেস্টিনেশন ইজ অলসো বেঙ্গল!’’
এ দিন দফায় দফায় পশ্চিমবঙ্গ শিল্পোন্নয়ন পর্ষদ এবং ব্রিটেন-ভারত বাণিজ্য পর্ষদের মধ্যে মোট ২২টি মউ সই করেছেন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র। এর মধ্যে শিল্প সংক্রান্ত মউ ১১টি, স্বাস্থ্য ও উচ্চশিক্ষা সংক্রান্ত ৪টি করে মোট ৮টি, নগরোন্নয়ন সংক্রান্ত ২টি এবং পরিবহণ সংক্রান্ত মউ ১টি। মোট কত টাকার মউ স্বাক্ষরিত হল, জানতে চাওয়া হলে অমিতবাবুর জবাব, ‘‘কিছু মউ বাণিজ্যিক হলেও বেশির ভাগই সামাজিক ক্ষেত্রে সহায়তা এবং পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে। ফলে টাকার অঙ্কে সেগুলিকে মাপা যাবে না।’’
— নিজস্ব চিত্র।