ছত্রপুরে শেষ হয়নি মডেল স্কুল তৈরির কাজ। ছবি: তরুণ দেবনাথ।
পশ্চিম দিনাজপুর জেলা ভেঙে উত্তর দিনাজপুর জেলা গঠনের দু’দশকেরও বেশি সময় গড়িয়েছে। এখনও সরকারি উদ্যোগে শহরে কোনও ইংরাজি মাধ্যমের স্কুল হয়নি। নেই স্কুল ও কলেজ পড়ুয়াদের কেরিয়ারের দিশা দেখানোর কোনও ব্যবস্থাও। তাই বেশি টাকা দিয়ে বেসরকারি স্কুল বা চাকরির প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রতিষ্ঠানের উপরেই নির্ভর করতে হচ্ছে। ক্ষুব্ধ বাসিন্দাদের প্রশ্ন, “এই সব সুযোগ পেতে আর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে শহরের ছাত্রছাত্রীদের?”
প্রশাসনিক সূত্রের খবর, ২০১৩ সালের ৯ মার্চ রায়গঞ্জের কমলাবাড়ি পঞ্চায়েতের ছত্রপুর এলাকায় কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যাকওয়ার্ড রিলিজিয়ন গ্রান্ট ফান্ডের ১০ কোটি টাকা খরচে একটি মাধ্যমের একটি মডেল স্কুল তৈরির কাজ শুরু হয়। প্রায় তিন একর সরকারি জমিতে হওয়া এখনও পর্যন্ত সেই কাজ শেষ হয়নি। উত্তর দিনাজপুরের জেলাশাসক স্মিতা পাণ্ডে জানান, ছত্রপুর এলাকার ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল তৈরির কাজ দ্রুত শেষ করার চেষ্টা চলছে। রায়গঞ্জে শিক্ষার উন্নয়নে কী কী করণীয়, তা জেলা সর্বশিক্ষা মিশন ও জেলা বিদ্যালয় দফতরের সঙ্গে আলোচনা করে উপযুক্ত পদক্ষেপ করা হবে।
রায়গঞ্জ শহরে দুটি ইংরেজি মাধ্যমের বেসরকারি স্কুল রয়েছে। স্কুলগুলিতে নার্সারি স্তর থেকে উচ্চ-মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত পড়ানো হয়। অভিভাবকদের অনেকেরই অভিযোগ, বেসরকারি স্কুলগুলিতে বিভিন্ন ক্লাসে প্রতি মাসে টিউশন ফি-সহ নানা খাতে গড়ে ৫ হাজারেরও বেশি হাজার টাকা দিতে হয়। তাছাড়া প্রতি বছর মোটা টাকা অ্যাডমিশন ফি দিতে হয়। তাই বেশিরভাগ অভিভাবকদের পক্ষে ইচ্ছে থাকলেও তাঁদের ছেলেমেয়েদের ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে ভর্তি করতে পারেন না।
রায়গঞ্জ করোনেশন হাইস্কুলে প্রায় চার বছর আগে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে ইংরেজি মাধ্যমের পঠনপাঠন চালু হয়। তবে এখনও রাজ্য শিক্ষা দফতর ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষক নিয়োগ না করায় পঠনপাঠন ব্যাহত হচ্ছে বলে স্কুল কর্তৃপক্ষের দাবি। প্রায় দু’বছর আগে সরকারি অনুমোদন মিললেও রায়গঞ্জের সুদর্শনপুর দ্বারিকাপ্রসাদ উচ্চ বিদ্যাচক্রে শিক্ষকের অভাবে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে ইংরেজিমাধ্যমে পঠনপাঠন চালু করতে পারেননি স্কুল কর্তৃপক্ষ।
রায়গঞ্জের পূর্ব নেতাজিপল্লি এলাকার বাসিন্দা ওষুধ বিপণন কর্মী তন্ময় সাহা ও শিল্পীনগর এলাকার বাসিন্দা সেলুন মালিক বাপ্পা ঠাকুরের মতে, “প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে ও ভবিষ্যতে স্বনির্ভরতার স্বার্থে বর্তমানে ছেলেমেয়েদের প্রাথমিক স্তর থেকে ইংরেজিমাধ্যমে পড়াশোনা করা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু ইংরেজি মাধ্যমের বেসরকারি স্কুলগুলিতে পড়াশোনার খরচ বেশি হওয়ায় অনেক অভিভাবকই তাঁদের ছেলেমেয়েদের ভর্তি করতে পারেন না।” তন্ময়বাবুর কথায়, “আর্থিক সমস্যার কারণে আমার মেয়েকে ইচ্ছে সত্ত্বেও ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে ভর্তি করতে পারিনি। রায়গঞ্জ জেলা সদরের মর্যাদা পাওয়ার পরে দু’দশকের বেশি সময় গড়ালেও কেনও সরকারি উদ্যোগে শহরে ইংরেজিমাধ্যমের স্কুল এখনও হল না, তা বুঝতে পারছি না।”
শহরের বিভিন্ন নামী স্কুলের শিক্ষকদের ক্ষোভ রয়েছে অন্য একটি বিষয়েও। তা হল, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পড়ুয়াদের মেধা অনুযায়ী শিক্ষা ও স্বনিভর্রতার দিশা দিতে সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে রায়গঞ্জ শহরে এখনও পর্যন্ত কেরিয়ার কাউন্সেলিং বা কেরিয়ার সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়ার মতো কোনও প্রশিক্ষণকেন্দ্র চালু হয়নি। এছাড়া রায়গঞ্জ শহরে স্কুল ও কলেজ পড়ুয়াদের জন্য চাকরির পরীক্ষার কোচিংয়ের কোনও পরিকাঠামোও এখনও পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি।
রায়গঞ্জ করোনেশন হাইস্কুলের প্রধানশিক্ষক শুভেন্দু মুখোপাধ্যায় জানান, প্রতি বছর শহরের বিভিন্ন স্কুল থেকে বহু পড়ুয়া মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় নজরকাড়া ফল করেন। তবুও মেধা অনুযায়ী তাঁরা পরবর্তীতে কোন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করবেন বা স্বনির্ভরতার লক্ষ্যে তাঁদের কী করণীয়, সেই বিষয়ে যথাযথ ধারণা পাওয়া থেকে তাঁরা বঞ্চিত হন। বেশিরভাগ পড়ুয়ারই লক্ষ্য থাকে বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করার। তবে বহু পড়ুয়ারই আক্ষেপ, কলা ও বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেও যে নানাধরনের বিভিন্ন পেশায় গিয়ে স্বনির্ভর ও প্রতিষ্ঠিত হওয়া যায়, সেই বিষয়ে আমরা কোনও ধারণাই পান না। শুভেন্দুবাবুর কথায়, সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে শহরে কেরিয়ার ওরিয়েন্টেশন, কেরিয়ার কাউন্সেলিং বা কেরিয়ার হাব চালু হলে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পর মেধা অনুযায়ী পড়ুয়ারা কী বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করতে পারবেন ও স্বনির্ভরতার জন্য তাঁর কী করণীয় সে বিষয়ে উপযুক্ত ধারণা পাবেন।
তাঁদের মতে, সেইসঙ্গে মেধা অনুযায়ী বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষার জন্য শহরে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও গড়ে ওঠা জরুরি। কারণ, আমরা দেখেছি প্রতি বছর বহু পড়ুয়া নানা পরীক্ষায় পাশ করে চাকরির পরীক্ষায় পাশ করার জন্য কলকাতার বিভিন্ন কোচিং সেন্টারে মোটা টাকা দিয়ে ভর্তি হতে বাধ্য হচ্ছেন। এ বিষয়ে পুরসভা কী ভাবছে? পুরসভার চেয়ারম্যান মোহিত সেনগুপ্ত জানান, শহরের মোহনবাটি এলাকায় পুরসভার একটি প্রাথমিক স্কুলের পরিকাঠামো উন্নয়ন করে ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল চালু করার চেষ্টা চলছে। ভবিষ্যতে পড়ুয়াদের স্বার্থে কেরিয়ার কাউন্সেলিং, কেরিয়ার হাব ও চাকরির প্রশিক্ষণের কোচিংয়ের ব্যবস্থা চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে। মোহিতবাবু জানান, ইংরেজি মাধ্যমের সরকারি স্কুল না থাকায় বেশির ভাগ অভিভাবক ইচ্ছে থাকলেও এত বেশি ফি দিয়ে তাঁদের ছেলেমেয়েদের ইংরেজি মাধ্যমের বেসরকারি স্কুলগুলিতে ভর্তি করতে পারেন না।
এইমসের ধাঁচে হাসপাতাল হয়নি। শিক্ষা-নিয়েও হাজারো ক্ষোভ শহরবাসীর। তবে এর মধ্যেই একটি বিষয়কে ঘিরে তাঁরা আশার আলো দেখছেন।
(চলবে)