ভিক্ষায় চলে সংসার, মান রাখল মানোয়ার

অসুস্থ বাবাকে নিয়ে যে ছেলে বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করে বেড়াত, আজ তাকে দেখতে ভিড়। কারণ, মাধ্যমিকে ৬৩০ পেয়েছে হতদরিদ্র ঘরের ছেলে মানোয়ার হোসেন। যা শুনে শুক্রবার ওই বাড়িতে যান জলপাইগুড়ি জেলা পরিষদ সভাধিপতি নুরজাহান বেগম।

Advertisement

নিলয় দাস ও নারায়ণ দে

আলিপুরদুয়ার ও শালকুমারহাট শেষ আপডেট: ২৪ মে ২০১৪ ০১:৫৫
Share:

বাবা রসিদুল ও মা সায়রা বিবির সঙ্গে মানোয়ার। শুক্রবার ছবিটি তুলেছেন রাজকুমার মোদক।

অসুস্থ বাবাকে নিয়ে যে ছেলে বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করে বেড়াত, আজ তাকে দেখতে ভিড়। কারণ, মাধ্যমিকে ৬৩০ পেয়েছে হতদরিদ্র ঘরের ছেলে মানোয়ার হোসেন। যা শুনে শুক্রবার ওই বাড়িতে যান জলপাইগুড়ি জেলা পরিষদ সভাধিপতি নুরজাহান বেগম।

Advertisement

ডুয়ার্সের আলিপুরদুয়ার ১ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের শালকুমারহাট গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার জলদাপাড়া জঙ্গল সংলগ্ন প্রধানপাড়ার বাসিন্দা মানোয়ার। বাবা রসিদুল ইসলাম কথা বলতে পারেন না। দুই ভাই এক বোন আর মা এই পাঁচ জনকে নিয়ে তাদের সংসার। ভাই-বোনের মধ্যে সে বড়। পাটকাঠির বেড়া দেওয়া তিনটি ঘর। গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছয়নি। বিপিএল তালিকায় নাম না থাকায় ইন্দিরা আবাস কিংবা রেশনের বরাদ্দ তেমন মেলে না। ভিক্ষের উপার্জনে যা আসে তাতে কোনও দিন দুবেলা, কোনও দিন একবেলা খাবার জোটে। তারই মধ্যে পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছে মানোয়ার। বৃহস্পতিবার ফল প্রকাশিত হওয়ার পরে তাই লাল্টুরাম হাইস্কুল জুড়ে উৎসব শুরু হয়।

স্কুলের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের মধ্যে মানোয়ার সবার চেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছে। শুধু তাই নয়, স্কুল মাধ্যমিকের অনুমোদন পাওয়ায়র পরে সাত বছরের মধ্যে এক মাত্র মানোয়ার সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়ে সর্বকালীন রেকর্ড গড়েছে। স্কুলের শিক্ষকদের ওই অবদানের কথা সে কোনও দিন ভুলবে না বলে জানিয়েছে মানোয়ার।

Advertisement

ক্লাস নাইনে পড়াশোনা করাকালীন আচমকা মানোয়ারের বাবা কথা বলার ক্ষমতা হারান। রসিদুল তাঁর ছেলের সাফল্যে খুশি। প্রতিবেদকের থেকে কাগজ কলম নিয়ে গ্রামের সেরা ওই ছাত্রের বাবা লেখেন, “আমার প্রথম থেকে খুব আশা, ছেলে ডাক্তার হোক। তবে সে জন্য প্রচুর টাকার প্রয়োজন। সাহায্য পেলে ও ঠিক ডাক্তার হবে।”

মানোয়ারের মা সায়রা বিবি পেটে টিউমারে ভুগছেন। মাঝেমধ্যে জ্ঞান হারান। চিকিৎসক অপারেশনের কথা বললেও ২০ হাজার টাকা না থাকায় সেই অপারেশন আর করানো হয়নি। মানোয়ারের কথায়, “মায়ের চিকিৎসা হয় না। কয়েকশো টাকা জোটাতে হিমসিম খেতে হয়। অত হাজার টাকা খরচ করে অপারেশন করাব কী ভাবে? তাই মাঝে মধ্যে ব্যাথার ওষুধ খাইয়ে মাকে কোনও ভাবে সুস্থ রাখছি।”

বাড়িতে বিদ্যুৎ নেই। খোলাবাজারে কেরোসিনের দাম অনেক। কাকভোরে মানোয়ার ঘুম থেকে উঠে পড়াশোনা করত। বাবা মাঝেমধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়লে মানোয়ারের কাঁধে ভর করে তিনি এ-বাড়ি ও-বাড়ি ভিক্ষা করেন। সে জন্য কোন দিন স্কুলে যাওয়া হত, আবার কোনও কোনও দিন বাধ্য হয়ে তাকে স্কুল ফাঁকি দিতে হয়েছে।

স্কুলের শিক্ষকরা টিফিনের সময়ে মানোয়ারকে অঙ্ক, ইংরেজি, ভূগোল পড়া দেখিয়ে দিতেন। তাতে সে বাংলায়, ৯০, ইরেজিতে ৮৪, অঙ্কে ৯৪, ভৌতবিজ্ঞানে ৮০, জীবনবিজ্ঞানে ৯২ ইতিহাসে ৯৩ আর ভূগোলে ৯৭ পেয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। মানোয়ারের কথায়, “বাবার ইচ্ছা আমি ডাক্তার হই। পড়শোনা করতে পারলে ডাক্তার হয়ে দেখাব। জানি না সুযোগ মিলবে কিনা?”

লাল্টুরাম হাইস্কুলে ইংরেজি শিক্ষক ভজন বিশ্বাস জানিয়েছেন, কলাবাড়িয়া এলাকা থেকে ৬-৭ কিমি হেঁটে স্কুলে আসত ছাত্রটি। মেধাবী দেখে শিক্ষকরা তাকে একটি সাইকেল কিনে দেন। পরে মনোয়ারের পরিবার স্কুলের কাছে নতুনপাড়া এলাকায় চলে আসে। স্কুলে প্রথম থেকেই ভজনবাবু ওকে ইংরেজি পড়াতেন। প্রয়োজনে নিজের বাড়িতে ওকে ডেকে নিয়ে। ক্লাস নাইনে ওঠার পরেও যাতে দুপুরের খাওয়ার কোনো অসুবিধে না হয় সে জন্য মিড ডে মিল থেকে মানোয়ারকে খাবার দেওয়ার বিশেষ অনুমতি দিয়েছিলেন স্কুলের শিক্ষকরা। তাঁরা পোশাক ও বই দিয়ে মানোয়ারকে সাহায্য করতেন। প্রধান শিক্ষক প্রাণতোষ পাল এ দিন বলেন, “অর্থাভাবে ওর হয়তো বিজ্ঞান নিয়ে পড়া হবে না। কলা বিভাগে একাদশ শ্রেণিতে ওকে ভর্তি হতে হবে।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement