বসতির চাপে পরিকল্পনা ছাড়াই বাড়ছে বালুরঘাট

হাসপাতালের মর্গ লাগোয়া এলাকায় যে ছবি ইদানীং রাত-বিরেতে দেখা যায় তার বিপরীত চিত্রও রয়েছে। যেমন গোবিন্দপুর গ্রামের কথাই ধরা যাক। যে গাঁয়ের কোনও গুরুত্ব ছিল না বছর দশেক আগেও। বিকেল গড়ালে ওই গাঁ হয়ে যেত সুনসান।

Advertisement

অনুপরতন মোহান্ত

বালুরঘাট শেষ আপডেট: ১৪ অগস্ট ২০১৪ ০৩:০৭
Share:

শহর বাড়ার সঙ্গেই বেড়েছে জনসংখ্যা। তবে সেই অনুযায়ী ট্রেনের দাবি পূরণ হয়নি। ছবি: অমিত মোহান্ত।

হাসপাতালের মর্গ লাগোয়া এলাকায় যে ছবি ইদানীং রাত-বিরেতে দেখা যায় তার বিপরীত চিত্রও রয়েছে। যেমন গোবিন্দপুর গ্রামের কথাই ধরা যাক। যে গাঁয়ের কোনও গুরুত্ব ছিল না বছর দশেক আগেও। বিকেল গড়ালে ওই গাঁ হয়ে যেত সুনসান। শেয়ালের ডাক। ঝিঁ ঝিঁ পোকার আওয়াজ। মাঝে মধ্যে তারস্বরে কুকুরের চিত্‌কার। তো এখন সেই গোবিন্দপুর গভীর রাতেও জমজমাট। কারণ, দক্ষিণ দিনাজপুরের অন্যতম ব্যস্ত রেল স্টেশন হয়েছে এখানেই। গোবিন্দপুরে ‘বালুরঘাট স্টেশন’ হওয়ায় ছবিটাই পাল্টে গিয়েছে। বেড়েছে নিরাপত্তার ব্যবস্থাও। লোক সমাগম হওয়ায় এলাকায় ছোটখাট ব্যবসার প্রসারও ঘটছে। কিন্তু বালুরঘাটের বাসিন্দাদের চাহিদা মেনে ট্রেনের সংখ্যা বাড়ছে না।

Advertisement

অথচ বালুরঘাটের ব্যবসায়ীদের অনেকেই মনে করেন, যদি বালুরঘাট থেকে আরও কয়েকটি প্যাসেঞ্জার ট্রেন চালাত রেল, তা হলে এলাকার লোকজনের সব দিক থেকেই সুবিধা হতো। পড়াশোনা, ব্যবসা ও অন্য সব ক্ষেত্রেই কলকাতা, মালদহ ও শিলিগুড়িতে থাকা পরিকাঠামোর সুযোগ নিতে পারত বালুরঘাট। বালুরঘাটের ব্যবসায়ী সমিতির এক কর্তা জানান, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেলমন্ত্রী থাকাকালীন রেল যা করার করেছে। ইদানীং নানা ভাবে রেল মন্ত্রকে যোগাযোগ করেও কোনও দাবি-দাওয়া পূরণের আশ্বাস পাননি ব্যবসায়ীরা।

একটা সময়ে কিন্তু বালুরঘাটকে কেন্দ্র করেই জমজমাট ব্যবসা চলত। সেকালের বালুরঘাটের আত্রেয়ী নদীরঘাট থেকে ঢাকা, ময়মনসিং, খুলনা, ফরিদপুর, বরিশাল, যশোহর, পাবনা থেকে কয়েকশো হাজারমণি বড় বড় নৌকা ভাদ্র আশ্বিন মাসে বালুরঘাট নদী বন্দরে এসে ভিড়ত। ব্যাপারীরা এই বন্দর থেকে মোটা-মিহি ও সুগন্ধি জাতের অন্তত ১০ থেকে ১২ রকমের ধান ও চাল কিনে পূর্ব ও দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন শহরে বিক্রি করতেন। নৌকায় সেখান থেকে এই বন্দরে আমদানি হত উন্নত জাতের নারকোল। আত্রেয়ীর নদীপথ ধরেই সেকালে নৌকা করে চলত যাতায়াত ও ব্যবসা বাণিজ্য।

Advertisement

হান্টার কমিশনের গেজেটিয়ার থেকে জানা যায়, ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে অসম ও উত্তরবঙ্গে প্রবল ভূমিকম্পে বহু নদীর গতিপথ বদলে যায়। জলপ্লাবনে বিস্তীর্ণ এলাকার ফসল নষ্ট হয়। পরের বছর অজন্মায় এই অঞ্চলে দুর্ভিক্ষে মহামারি সৃষ্টি হয়। এই ভূমিকম্পের ফলে বালুরঘাটের আত্রেয়ী নদীও শহরের রঘুনাথপুরের কাছে তার পুরানো নদীখাত বদলে সরল পথে প্রবাহিত হতে থাকে। ফলে, পুরানো খাত ক্রমে ভরাট হয়ে মেড়ার মাঠ নামে গোচারণ ক্ষেত্রে পরিণত হয়। মেড়ার মাঠের উত্তর অংশের নাম হয় বেলতলা পার্ক আর দক্ষিণ অংশে বর্তমান বালুরঘাট হাইস্কুলের মাঠ। তারও দক্ষিণে ফেন্ডস ইউনিয়ন ও টাউন ক্লাবের ফুটবল মাঠ। স্বাধীনতার পর ওই মাঠ দুটিতে নতুন বসতি গড়ে ওঠে আর আত্রেয়ীর গভীর স্রোতধারাটি ক্রমশ সংকীর্ণ হয়ে আত্রেয়ী খাঁড়ি নামে চিহিৃত হয়ে শহরের মধ্যে দিয়ে প্রভাবিত হয়ে কল্যাণীঘাটের কাছে মূল আত্রেয়ীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে।

অতীতের সেই বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডের কথা মাথায় রেখে নতুন করে কেন বাণিজ্য প্রসারের পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে না?

বালুরঘাট পুরসভার সঙ্গে যুক্ত নেতা-কর্মীরা প্রায় সকলেই একই সুরে জানিয়েছেন, উন্নতি যে একেবারে হয়নি সেটা বলাটা ঠিক হবে না। যেমন, বালুরঘাটের পাবলিক বাসস্ট্যান্ড, সত্যজিত্‌ মঞ্চ থেকে পাকা রাস্তা, নিকাশি নালা এবং ট্যাপের মাধ্যমে পানীয় জল পেয়েছে বালুরঘাট। শহরের প্রাক্তন শিক্ষক সুভাষ সাহা বলেন, “অতীতে রাস্তা দখল করা হলে পুরসভা কড়া ব্যবস্থা নিত। ইদীনাং তেমন খুব একটা হয় না বলেই নানা সমস্যা জটিল হয়েছে।”

তবে গত ৬ দশক ধরে বালুরঘাটে একাধিক পার্ক, সুইমিং পুল, দুটি নাট্যমঞ্চ হয়েছে। কিন্তু জনবসতির চাপের কথা মাথায় রেখে শহরকে আরও পরিকল্পিত ভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার কথা যে ভাবা হয়নি, সে কথা পুরসভার অনেক প্রাক্তন ও বর্তমান কর্তাই একান্তে স্বীকার করেন।

(চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement