এক সময়ে করলা-পাড় সাজানো হলেও এখন তা অবহেলায় পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে। জলপাইগুড়িতে। —নিজস্ব চিত্র।
বিষ-কাণ্ডের পরে আড়াই বছর কেটে গিয়েছে। কিন্তু বিষকাণ্ডের ধাক্কা সামলে নদী পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি বলেই বিশেষজ্ঞদের মত।
জলপাইগুড়ি শহরের বুক চিরে প্রবাহিত করলায় নদীতে ২০১১ সালের নভেম্বরে বিষকাণ্ডে মাছের মড়ক হয়। মৎস্য দফতরের সমীক্ষা অনুযায়ী, অন্তত ১৫০ প্রজাতির মাছের মৃত্যু হয়। নদী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় অন্তত ৩০টি প্রজাতির মাছ। তার পরে নদীর জল পরিষ্কার করা থেকে শুরু করে নতুন করে মাছ ছাড়া সবই হয়েছে। কিন্তু বিষকাণ্ডের পরে নদীতে মাছের সংখ্যা বাড়লেও, করলায় মাছেদের স্বাভাবিক প্রজনন এখনও শুরু হয়নি বলে সমীক্ষায় জানা গিয়েছে। বিষকাণ্ডের পরে অন্তত ৯ মাস ধরে নদীতে যত বার মাছের চারা ছাড়া হয়েছে, প্রতিবারই সিংহভাগ চারার মৃত্যু হয়েছে বলে দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে। দূষণের কারণেই এই ঘটনা ঘটেছে বলে মনে করছে দফতর। তবে গত বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে নদীতে যে মাছের চারা ছাড়া হয়েছে, সেগুলি ভাল ভাবেই রয়েছে বলে জানা গিয়েছে। তবে সদ্য নদীতে ছাড়া সেই মাছগুলি পূর্ণবয়স্ক হয়ে প্রজনন শুরু করতে আরও সময় প্রয়োজন বলে সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে। মৎস্য দফতর জানাচ্ছে, সেই মাছের প্রজনন ক্ষমতা হলে তবেই করলার মাছেরা স্বাভাবিক অবস্থায় রয়েছে বলে ধরা হবে।
ফিশ ফার্মার ডেভেলপমেন্ট এজেন্সির জেলার মুখ্য কার্যনির্বাহী আধিকারিক সুমন সাহা বলেন, “বিষকাণ্ডের পর থেকে নদীতে প্রচুর মাছের চারা ছাড়া হয়েছে। সেগুলির প্রজননের ক্ষমতা না হওয়া পর্যন্ত নদীতে মাছেদের জীবনচক্র স্বাভাবিক হয়েছে, এ কথা বলা যাবে না। আরও অন্তত বছর দেড়েক তার জন্য সময় চাই। নদীতে দূষণ চলতে থাকাতেই সময় লাগছে।”মৎস্য দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, রুই, কাতলা, বোয়াল, বাটা, পুঁটি, বোরোলি, মাগুর সব ধরণের মাছের চারাই নদীতে ছাড়া হয়েছে। বিষ-কাণ্ডে বড়, ছোট সব ধরনের মাছের মড়ক হয়েছিল। বোরোলি, ট্যাংরা, পুঁটির মতো ছোট প্রজাতির মাছগুলি করলা নদী থেকে সাময়িক ভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। একটি নিষিদ্ধ কীটনাশক প্রচুর পরিমাণে নদীর জলে মিশে যাওয়াতেই মাছের মড়ক হয়েছিল বলে মৎস্য দফতর এবং ফরেন্সিক রিপোর্টে জানা যায়। সেই সময় মুখ্যমন্ত্রী ঘটনা নিয়ে তদন্তের নির্দেশ দেন। এর পরে করলা নদীকে কেন্দ্র করে সরকারি নানা প্রকল্প ঘোষণা করা হলেও, দূষণের সমস্যা এখনও রয়ে গিয়েছে বলে মৎস্য দফতরের আধিকারিকরা অভিযোগ করেছেন। এক আধিকারিকের কথায়, “করলায় যে ভাবে নির্বিচারে শহরের বিষাক্ত বর্জ্য ফেলা হয় তা উদ্বেগজনক। এই প্রবণতা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন।”
মৎস্য দফতরের এই আশঙ্কা যে অমূলক নয়, তার প্রমাণ মিলেছে রাজ্যের দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের রিপোর্টে। বিষ-কাণ্ডের পাঁচ দিনের মাথায় নদীর জলের নমুনা পরীক্ষা করে প্রতি লিটার জলে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ যা ছিল, বর্তমানে সেই পরিমাণ আরও কিছুটা কমেছে বলে জানা গিয়েছে। দূষণের কারণেই এমন হচ্ছে বলে অভিযোগ। জলপাইগুড়ি পুরসভার চেয়ারম্যান মোহন বসু এ দিন বলেন, “রাজ্য সরকার করলা অ্যাকশন প্ল্যানে অর্থ বরাদ্দ করেছে। সেই কাজ শীঘ্রই শুরু হবে। করলাকে দূষণের থেকে বাঁচাতে নজরদারিও শুরু হয়েছে। কোন এলাকা থেকে দূষণ ছড়ানোর প্রবণতা বেশি, সে দিকে নজর রাখা হচ্ছে।” দূষণ-উদ্বেগে পরিবেশ প্রেমী সংগঠনগুলিও। এক পরিবেশ কর্মী রাজা রাউত বলেন, “করলায় বিষ-কাণ্ড থেকে যে খুব বেশি শিক্ষা আমরা নিইনি, তা নদীর দিকে নজর দিলেই বোঝা যায়। শুধু পুরসভা বা প্রশাসন নয়, এই ব্যাপারে সাধারণ বাসিন্দারা সচেতন না হলে হাল ফিরবে না।”