জলপাইগুড়ি মিউনিসিপ্যাল মার্কেটের রোজকার দৃশ্য এমনই। তথৈবচ অন্য বাজারগুলিও। নিজস্ব চিত্র।
সকালবেলায় দিনবাজারে বাজার করতে যান জলপাইগুড়ি বিডিও অফিসের কর্মী সুব্রত ঘোষ। কিন্তু, রোজই বাজার থেকে তিতিবিরক্ত হয়ে ফিরতে বাধ্য হন। কারণ, বাজারের রাস্তার হাল শোচনীয়। জলকাদায় প্যাচপ্যাচ করছে। সারা বছরই যেন বর্ষায়। তা হলে বর্ষার সময়ে কী অবস্থা হতে পারে সেটা বোঝাই যায়। বাজারের একাংশে এমন দুর্গন্ধ যে সেখানে গেলে বমি হওয়ার উপক্রম।
একই অভিজ্ঞতা শহরের জীবন বিমা নিগমের কর্মী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের। বয়েলখানা বাজারেও তাঁকে যেতে হয়। জলপাইগুড়ি শহরের ওই অন্যতম প্রাচীন বাজারের যা হাল তাতে দুর্ভোগ নিশ্চিত। আশির দশকে গড়ে ওঠা বয়েলখানা পুরবাজারেও নিকাশি বেহাল। সেখানে জল-জঞ্জাল মিলেমিশে একাকার। পার্থবাবু মনে করেন, পরিকল্পনা অনুযায়ী বাজারটি গড়ে ওঠেনি বলেই সমস্যা ফুরোবার নয়। জলপাইগুড়ি শহরের পুর এলাকায় আরও বাজার আছে। সেগুলি হল মিউনিসিপ্যাল মার্কেট, পান্ডাপাড়ার বউবাজার, রেসকোর্সপাড়ার বিবেকানন্দ মার্কেট এবং মাসকলাইবাড়ি বাজার। পরিষেবা বেহাল হওয়ার ব্যাপারে একে অন্যের সঙ্গে যেন পাল্লা দিচ্ছে বলে ভুক্তভোগীরা মনে করেন।
দিনবাজারের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন ধরে সংস্কার না হওয়ায় রাস্তার অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে গিয়েছে। বাজারে জল ব্যবহার করেন প্রায় কমবেশি সব বিক্রেতাই। ফলে, রাস্তা সব সময় কাদা হয়ে থাকে। বাজারের নিকাশি নালা ঠিকঠাক সাফাই হয় না। নর্দমার জল উপচে রাস্তায় উঠে যায়। অনেক নিকাশি নালার দেওয়াল ভেঙে পড়েছে। পানীয় জলের কলের সংখ্যা হাতে গোনা।
কালিবাড়ি ঘাটের কাছে পুরসভার একটি জলের ট্যাঙ্ক দীর্ঘদিন ধরে অকেজো হয়ে পড়ে আছে। বাজারের শৌচাগারগুলি চরম অপরিচ্ছন্ন। সব্জিবাজারের একটি শৌচাগারের অবস্থা পুরোপুরি বেহাল। মুড়ি বাজারের কাছে একটি শৌচাগারের ট্যাঙ্ক ভেঙে বসে গিয়েছে। পৌরসভার সুপার মার্কেট বিল্ডিং সংস্কারের প্রয়োজন। পাইকারি মাছ বাজারের শেডের টিন দিয়ে জল পড়ে। কোনও বাজারে ঠিকঠাক পথবাতি নেই। যেগুলি আছে সেগুলিও জ্বলে না। করলা সেতুর কাছে দিনবাজারের একটি কালভার্টের অবস্থা খারাপ। যে কোন সময় ভেঙে পড়তে পারে। আরও উদ্বেগের বিষয় হল, দিনবাজারে আপতকালীন অবস্থা মোকাবিলার জন্য কোনও জলাধার নেই। বাজারে নিয়মিত আবর্জনা পরিস্কার না হওয়ায় বাজারে একটি অংশ থেকে দুর্গন্ধ বার হয়।
একঝলকে একটু অতীতের দিকে দেখা যাক। ১৮৬৯ সালের ১ জানুয়ারি জলপাইগুড়ি জেলা গঠন হয়। ১৪৬ বছরের জলপাইগুড়ি শহরের প্রাচীনতম বাজার এই দিনবাজার। শহরের জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ১৮৮০ জলপাইগুড়ি রায়কত রাজবংশের রানি জগদিশ্বরী দেবী এই বাজারের প্রতিষ্ঠা করান। ১৮৯৩ সালে এক ভয়ঙ্কর অগ্নিকান্ডের ফলে দিনবাজার ভস্মীভূত হয়ে যায়। এর পরে রাজা ফণীন্দ্রদেব রায়কতের পরিকল্পনা অনুযায়ী গড়ে ওঠে দিনবাজার।
১৯৫৬ সাল জলপাইগুড়ি পুরসভার পক্ষ থেকে রাজকুমারী প্রতিভা দেবীকে নোটিস দিয়ে দিনবাজার সংস্কারের কথা বলা হয়। তার সংস্কার মন মতো না-হওয়ায় পুরসভা ৩০ বছরের জন্য লিজ নিয়ে দিনবাজার নিজেরা পরিচালনা করতে থাকে। তার পর ৩০ বছর অতিক্রান্ত হলে রাজকুমারী প্রতিভা দেবীর সত্ত্ব বিলোপ করে দিনবাজারকে পৌর সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করা হয়। কিন্তু যে সংস্কারের পরিকল্পনা নিয়ে দিনবাজারকে জলপাইগুড়ি পুরসভার ভেতরে নিয়ে আসা হয় তা কতদূর হয়েছে? বর্তমান বাজারের যা হাল তাতে সেই লক্ষ্য যে পূরণ হয়নি তা স্পষ্ট।
দিনবাজারটি জলপাইগুড়ি শহরের অন্যতম পাইকাররি এবং খুচরো বাজার। সেখানে কাপড়, মাছ, সব্জি, মুদিখানার জিনিশ, চাল, ফল, পান সুপারি থেকে গেরস্থালির সব কিছু পাইকারি এবং খুচরো বিক্রি হয়। এখান থেকেই শহরের অন্যান্য বাজারে সব কিছু সরবরাহ হয়ে থাকে। দিনবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক দেবু চৌধুরী বলেন, “দিনবাজারের অবস্থা শোচনীয়। কয়েক বছর ধরে কোন উন্নয়ন হয় না। এখন নতুন বাজার তৈরির রূপরেখা হবে শুনেছি। কত দিনে তৈরি হবে? ব্যবসায়ীরা কোথায় বসবেন তার কিছুই ঠিক হয়নি। তার আগেই উন্নয়ন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে, ব্যবসায়ী এবং ক্রেতারা অসুবিধায় পড়েছেন।”
শহরের আরেক বাজার, বয়েলখানা পুরবাজারের ব্যবসায়ীরা কী বলছেন দেখা যাক?
(চলবে)