ঘটনার পরে জামালদহ এলাকায় অবরোধ করেন বাসিন্দারা। তার জেরে যান চলাচল ব্যাহত হয়।
মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের জন্য কোথাও সুষ্ঠু পরিবহণের ব্যবস্থা নেই। কোচবিহার থেকে মালদহ--উত্তরবঙ্গের সর্বত্রই একই অভিযোগ। প্রত্যন্ত এলাকা থেকে পরীক্ষাকেন্দ্রে পৌঁছতে প্রথম দিনই দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে ছাত্রছাত্রী এবং তাদের পরিবারের লোকদের। কোচবিহারের জামালদহে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে যাত্রী বোঝাই বাস উল্টে দুর্ঘটনাও ঘটে গেল।
এ দিন একের পর এক দুর্ঘটনায় মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের মৃত্যু ও আহত হওয়ার খবর পৌঁছেছে শিলিগুড়িতে মধ্যশিক্ষা পর্ষদের আঞ্চলিক কেন্দ্রে। তাদের তরফে অবশ্য জানানো হয় প্রশাসনকে পর্যাপ্ত গাড়ির ব্যবস্থা করতে আগে থেকেই জানানো হয়েছিল। সেই মতো ব্যবস্থা করা হবে বলে প্রশাসনের তরফে আশ্বাসও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে কোথাও যে শেষ পর্যন্ত গাড়ি দিয়ে পরীক্ষার্থীদের যাতায়াতের ব্যবস্থা করা যায়নি, এ দিন বহু ঘটনাই তার সাক্ষী।
উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণ সংস্থার চেয়ারম্যান তথা উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব বলেন, “কোচবিহারের মর্মান্তিক দুর্ঘটনার বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে। কয়েকজনকে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে চিকিত্সা করানো হবে। পরীক্ষার বাকি দিনগুলিতে উত্তরবঙ্গের কোনও রুটে যাতে পরীক্ষার্থীদের যাতায়াতে অসুবিধে না হয়, তা নিশ্চিত করতে সব রকম ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।”
ঘটনা হল, যাতায়াতে সমস্যা যে হতে পারে তা আগে থেকেই জানতেন অভিভাবকদের একাংশ। এ জন্য জামালদহের তুলসিদেবী হাইস্কুলের পরীক্ষার্থীদের অভিভাবকদের একাংশ বাস ভাড়া করে যাতায়াতের ব্যবস্থা করেছিলেন। তার পরেও এই ঘটনা কেন ঘটল? বাসিন্দারাই জানিয়েছেন, কিছু ছাত্রছাত্রী ভাড়া করা বাসে গেলেও অনেকেই যাওয়ার সময় বিভিন্ন ভাবে পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছেছে। ফেরার সময় বাস বা অন্য গাড়ি না পেয়ে তাদের অনেকে অন্যদের ভাড়া করা বাসেই উঠে পড়েন। ভিড় বাসে ঠাসাঠাসি করে উঠতে হচ্ছে দেখে অনেকে বাসের ছাদে উঠে পড়েন। বাস উল্টে সে কারণেই অনেকে জখম হন। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, পর্যাপ্ত গাড়ি থাকলে এ ভাবে ছাত্রছাত্রীদের বিপদে পড়তে হত না। প্রশাসনের তরফে কেন পর্যাপ্ত গাড়ির ব্যবস্থা করা হচ্ছে না, সেই প্রশ্ন তুলেছেন তারা।
উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণ সংস্থার ম্যানেজিং ডিরেক্টর সুবলচন্দ্র রায় বলেন, “প্রশাসন থেকে যে সমস্ত রুটে অতিরিক্ত বাস চালানোর কথা জানানো হয়েছিল সেই মতো ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কোচবিহার জেলার বিভিন্ন রুটে অতিরিক্ত ২০টি গাড়ি চালানো হয়েছে। জামালদহ রুটেও অতিরিক্ত একটি বাস চালানো হয়েছে। ওই রুটে আরও একটি অতিরিক্ত বাস চালানো হবে।”
ঘটনাস্থলে ভিড়।
তবে শুধু কোচবিহারের জামালদহই নয়, গাড়ি না পাওয়ায় ছাত্রছাত্রী এবং তাদের অভিভাবকদের বিপাকে পড়তে হয়েছে অন্যত্রও। ইসলামপুর, শিলিগুড়িতে পরীক্ষা দিয়ে ফেরার পথে কোথাও ভুটভুটিতে ঠাসাঠাসি করে যেতে গিয়ে, কোথাও বাইকে করে ৩ জন পরীক্ষার্থীকে নিয়ে যেতে গিয়ে পথ দুর্ঘটনায় কয়েকজন ছাত্র জখম হয়েছেন। পুলিশ সূত্রে খবর, এদিন সকালে ভুটভুটি করে চাকুলিয়া স্কুলে পরীক্ষা দিতে যাচ্ছিল চাকুলিয়ার গোয়ালগাঁও এলাকার স্কুল ছাত্রী আভারানি সিংহ। চাকুলিয়া সংলগ্ন এলাকাতে আচমকা ভুটভুটি থেকে পড়ে গিয়ে জখম হন ওই ছাত্রী। তাকে গুরুতর আহত অবস্থায় প্রথমে চাকুলিয়া ও পরে কিসানগঞ্জ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। ওই ঘটনায় আরও দু’জন পরীক্ষার্থী জখম হয়েছেন।
শিলিগুড়ির ফাঁসিদেওয়া চটহাট হাইস্কুলের তিন জন পরীক্ষার্থী বাইকে করে ফেরার সময় দুর্ঘটনা ঘটে। ১ জনকে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। পরীক্ষার জন্য যে সমস্ত অটোগুলিতে প্রশাসনের তরফে পরীক্ষার্থীদের জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল সেগুলির অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরীক্ষার্থী ছাড়া সাধারণ যাত্রীদেরই বেশি করে তুলেছেন চালকেরা। তাতেও সমস্যা বেড়েছে। শিলিগুড়ির ফাঁসিদেওয়ায় চটহাট হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক প্রেমানন্দ রায় বলেন, “গাড়ি না থাকায় মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের যাতায়াতে এ দিন দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে। প্রশাসনের তরফে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের লাউসিপাখরি এলাকায় পরীক্ষাকেন্দ্রে যেতে যে বাস দেওয়া হয়েছিল, তা ৯টার সময় চলে যায়। পৌনে ১২টায় পরীক্ষা বলে সে সময় অধিকাংশ পরীক্ষার্থীই যায়নি। ফাঁকা বাসই কার্যত চলে যায়। পরে ছাত্রছাত্রীরা বাইকে করে বিভিন্ন ভাবে গিয়েছে। একটা বাইকে ৪ জন করেও যেতে হয়েছে। তাতে দুর্ঘটনাও ঘটেছে।” এ দিন গাড়ির সমস্যার কথা জানিয়ে পুলিশে অভিযোগও জানান একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক।
এদিন দাদার সঙ্গে মোটর বাইকে করে পরীক্ষা দিতে যাওয়ার সময় পথ দুর্ঘটনায় জখম হয়েছে মালদহ জেলার কালিয়াচক-২ব্লকের বাঙ্গিটোলা এলাকায় ছাত্রী মবিয়া খাতুন (১৭)। তার বাড়ি কালিয়াচক-২ ব্লকের রথবাড়ি গ্রামপঞ্চায়েতের কমলপুর গ্রামে। মেহেরাপুর উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রী। পরীক্ষার সিট পড়েছিল বাঙিটোলা হাইস্কুলে। গাড়িতে যাতায়াতের সমস্যার জন্য দাদা জসিমউদ্দিনের সঙ্গে মোটরবাইকে করে পরীক্ষা দিতে যাচ্ছিল। মালদহ-মোথাবাড়ি রাজ্য সড়কে একটি ছাগলকে বাঁচাতে গিয়ে মোটরবাইকটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উল্টে যায়। স্থানীয় বাসিন্দারা দু’জনকেই উদ্ধার করে প্রথমে বাঙিটোলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যান। মবিয়ার জখম গুরুতর হওয়ায় তাকে মালদহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রেফার করা হয়। সে পরীক্ষা দিতে পারেননি।
চিকলিগুড়ি হাইস্কুলের মৌসুমী সাহা নামে এক ছাত্রী পরীক্ষা দিতে যাওয়ার সময় অটোরিকশা উল্টে জখম হন। কামাখ্যাগুড়ি হাইস্কুলে তার পরীক্ষার সিট পরেছিল। স্থানীয় বাসিন্দারা তাকে উদ্ধার করে কামাখ্যাগুড়ি ব্লক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে যান। গলা, হাত ও পিঠে আঘাত পেয়েছে মৌসুমী। প্রাথমিক চিকিত্সার পর ওই ছাত্রী অবশ্য পরীক্ষা দেয়। এদিকে কুমারগ্রামের খোয়ারডাঙ্গা-মারাখাতা রুটে পরীক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য কোনও বাসের ব্যবস্থা না থাকায় ৫১৭ জন ছাত্র ছাত্রীকে যাতায়াত করতে গিয়ে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের যাতায়াতের সুবিধার জন্য পর্যাপ্ত বাসের দাবি তুলেছেন বাসিন্দারা। তাদের কয়েকজনের অভিযোগ, এমনিতেই বাস চলাচল কম করে। বাসের জন্য দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষা করতে হয়। পরীক্ষার সময় তাই প্রশাসনের তরফে ব্যবস্থা করা হবে বলেই আশা করেছিলেন অনেকে। কিন্তু পর্যাপ্ত বাস না-থাকায় বিপাকে পড়তে হয় অনেক পড়ুয়াকে।
ছবি: দীপঙ্কর ঘটক।