দার্জিলিঙের রবার্টসন রোডে একটি বুথ পরিদর্শন করে বেরিয়ে আসছেন ভাইচুং ভুটিয়া। ছবি: রবিন রাই।
বিক্ষিপ্ত কিছু অশান্তির অভিযোগের মধ্যেও রাজ্যে প্রথম পর্বের লোকসভা নির্বাচনে ভোটের হার ৮০% ছাড়িয়ে গেল। উত্তরবঙ্গে দার্জিলিং, আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার কেন্দ্রে ৮২%-এর বেশি ভোট পড়েছে বলে রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক (সিইও) সুনীল গুপ্ত বৃহস্পতিবার রাতে জানিয়েছেন। এর মধ্যে কোচবিহার ছাড়া বাকি তিন আসনেই ভোটদানের হার গত বারের চেয়ে বাড়তে চলেছে। পাঁচ বছর আগে লোকসভায় কোচবিহারেই ৪ কেন্দ্রের মধ্যে ভোটদানের হার বেশি ছিল।
উত্তরবঙ্গে যে বেনিয়ম এবং গোলমালের অভিযোগ বিরোধীরা করেছে, তার বেশির ভাগ কোচবিহারেই। বামেদের মতোই কংগ্রেস এবং বিজেপি-রও অভিযোগ, কোচবিহারের অনেক বুথেই কেন্দ্রীয় বাহিনী না থাকার সুযোগ নিয়ে সকাল থেকে সন্ত্রাস চালায় তৃণমূল। জেলার তিনটি বিধানসভা কেন্দ্র তুফানগঞ্জ, শীতলখুচি, কোচবিহার দক্ষিণে শাসক দলের সন্ত্রাসের প্রতিবাদে কিছু ক্ষণের জন্য জেলাশাসকের দফতরে ধর্নায় বসেছিলেন কোচবিহারের ফব প্রার্থী দীপক রায়। অধিকাংশ অভিযোগই খারিজ করে দিয়েছে কমিশন। রাজ্যে কমিশনের বিশেষ পর্যবেক্ষক সুধীরকুমার রাকেশ বলেন, “ওই কেন্দ্রের যে ক’টি অভিযোগ এসেছে সব জেলাশাসক, এসপি, পর্যবেক্ষকদের কাছে পাঠানো হয়েছে। কোথাও ফব-র অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি।” কেন্দ্রীয় বাহিনীকে বসিয়ে রাখার অভিযোগও উড়িয়েছেন রাকেশ। দিনের শেষে বামেরাও মেনেছে, কমিশনের নজরে আনার পরে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে।
গোলমালের কিছু অভিযোগের মধ্যেও ভোটদানের শতাংশের হিসাব সব শিবিরকেই আশায় রেখেছে। কোচবিহারে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ভোটদানের হার ৮৩% ছাড়িয়েছে। দার্জিলিঙে ৮২%, জলপাইগুড়িতে ৮২%, আলিপুরদুয়ারে ৮০%-এর বেশি ভোট পড়েছে। লোকসভার সঙ্গেই কুমারগ্রাম এবং ময়নাগুড়ি বিধানসভার উপনির্বাচন ছিল। রাত পর্যন্ত খবর, কুমারগ্রামে ৮১% ভোট পড়েছে, যা ২০১১-র বিধানসভা ভোটের চেয়ে ৪% কম। নির্বিঘ্নে ভোট হয়েছে বলে সেখানে সব দলের প্রার্থীরাই দাবি করেছেন।
তৃণমূলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেও শেষ পর্যন্ত মানুষের উপরেই ভরসা রাখতে চেয়েছেন বাম নেতারা। নলহাটিতে ফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু বলেছেন, “অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের ক্ষেত্রে বাধা আসবে। আজকেই কোচবিহারে কয়েকটি বুথে ঝামেলা হয়েছে। আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়িতে ছোটখাটো অনিয়ম-বেনিয়ম হয়েছে। আমাদের এজেন্টদের ক’টি বুথে মেরে বার করে দেওয়া হয়েছে। যারা করেছে, তারা তৃণমূল।” সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য রবীন দেব আলিমুদ্দিনে বলেন, “তৃণমূলের সন্ত্রাস ও হুমকি সত্ত্বেও যে ভাবে মানুষ ভোট দিয়েছেন, তা সদর্থক। পঞ্চায়েতে যে ভাবে তৃণমূল ভোট লুঠ করেছিল, সেই চক্রান্ত অনেকটাই আটকানো গিয়েছে!”
রবীনবাবুর অভিযোগ, বুধবার থেকেই বিভিন্ন জায়গায় তৃণমূল ভয় দেখাচ্ছিল। অভিযোগ জানানোর পরে অনেক ক্ষেত্রেই কমিশন ব্যবস্থা নিয়েছে বলে রবীনবাবু মেনে নিয়েছেন। তিনি বলেন, “কোচবিহারের ৯২টি বুথে সকাল থেকে নানা ভাবে তৃণমূল বাধা সৃষ্টি করে। এ ব্যাপারে কমিশনের পর্যবেক্ষককে জানানোর পরে দুপুর দু’টোর পরে প্রায় ৩০টি কেন্দ্রে ভোট স্বাভাবিক হয়েছে।” কয়েকটি বিক্ষিপ্ত ঘটনা ছাড়া ভোট শান্তিপূর্ণ ভাবেই শেষ হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী। তাঁর বক্তব্য, “দার্জিলিঙে সাংগঠনিক দিক থেকে একটু দুর্বল হলেও বাকি তিন আসনে সমানে সমানে লড়তে পেরেছি!”
বিরোধীদের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে তৃণমূল নেতা মুকুল রায় দাবি করেন, প্রথম পর্ব থেকেই তাঁরা ৪-০ এগিয়ে গিয়েছেন! তাঁর কথায়, “চার কেন্দ্রেই কংগ্রেস-বিজেপি-বামেদের অশুভ আঁতাঁতকে মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছেন।’’ বিরোধীদের নস্যাৎ করে মুকুলবাবুর পাল্টা দাবি, “কোনও সন্ত্রাস হয়নি। বরং জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার এবং দার্জিলিঙে আমাদের দলের কর্মী-সমর্থকদের বিরোধীরা মারধর করেছে।” শাসক-বিরোধী চাপানউতোর জারি থাকলেও উত্তরবঙ্গের কোথাও বড় মাপের কোনও সংঘর্ষের খবর এ দিন আসেনি। সিইও সুনীলবাবুরও দাবি, ভোট হয়েছে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ। সারা দিনই ছোটখোটো অভিযোগ পাওয়া গেলেও কোথাওই ভোট বন্ধ থাকেনি। ২৮টি ইভিএম পরিবর্তন করতে হয়েছে। তবে কাশির্য়াঙে পুলিশ তিন জনকে গ্রেফতার করেছে। সুনীলবাবু জানান, পরবর্তী পর্বের ভোটের আগে ভোটকেন্দ্রগুলির বিভিন্ন এলাকায় কেন্দ্রীয় বাহিনীর টহলদারি বাড়ানো হবে।
ভোট দিলেন না ঘিসিঙ্গ
নিজস্ব সংবাদদাতা • দার্জিলিং
অসুস্থতার জন্য বৃহস্পতিবার ভোট দিতে পারলেন না জিএনএলএফ প্রধান সুবাস ঘিসিঙ্গ। এ দিন দার্জিলিং লোকসভা কেন্দ্রে নির্বাচন ছিল। দল সূত্রের খবর, ৭৮ বছর বয়সী ঘিসিঙ্গ দীর্ঘ দিন ধরেই হজমের সমস্যায় ভুগছেন। এ দিন সকালে জলখাবার খাওয়ার পরে ফের পেটের রোগে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। লোকসভা ভোটের আগেই শিলিগুড়ি লাগোয়া এলাকার ভাড়া বাড়ি ছেড়ে পাহাড়ে নিজের বাড়িতে ফিরেছেন ঘিসিঙ্গ। দার্জিলিঙের তৃণমূল প্রার্থী ভাইচুং ভুটিয়াকে সমর্থনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন তিনি। গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা বিরোধী জিএনএলএফ-এর কর্মী সমর্থকরা দলনেতার নির্দেশ মেনে পাহাড় জুড়ে তৃণমূল প্রার্থীর সমর্থনে আলাদা ভাবে প্রচারও চালিয়েছেন। এ দিন ঘিসিঙ্গ ভোট দিতে না যাওয়ায় মোর্চা তাঁকে কটাক্ষও করেছে। মোর্চার সাধারণ সম্পাদক রোশন গিরির দাবি, “তৃণমূলের প্রার্থী হারবে বুঝতে পেরেই, ঘিসিঙ্গ নিজে ভোট দেননি। সমর্থকদের ভোট দিতে বললেন, আর নিজে বুথে এলেন না, এটা কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতার সামিল।”