প্রতিমা গড়ার কাজে জলপাইগুড়ির অন্যতম প্রবীণ শিল্পী নরেন পাল। ছবি: রাজা বন্দ্যোপাধ্যায়।
প্রতিমা বানানোর জন্য পরবর্তী প্রজন্মের আগ্রহ নেই। নতুন কোনও শিল্পী তৈরি হচ্ছে না। বন্ধ হচ্ছে প্রতিমা তৈরির কারখানাগুলি। জলপাইগুড়ি শহরের শিল্পীদের আশঙ্কা, এ ভাবে চলতে থাকলে আগামী ১৫ বছরের মধ্যে প্রতিমা বানানোর জন্য আর কোনও শিল্পী পাওয়া যাবে না। সঙ্কট দেখা দেবে প্রতিমা শিল্পে। শিল্পীদের অভিযোগ রাজ্য সরকার থেকেও এই শিল্পটিকে বাঁচানোর জন্য কোন সহায়তা দেওয়া হচ্ছে না।
কম্পিউটার এবং নেট যুগে কাদামাটি ঘেঁটে কোনও শিল্পীর ছেলেমেয়েরা আর প্রতিমা বানাতে এগিয়ে আসছেন না। সকলেই পড়াশোনা শিখে অন্য পেশায় চলে যেতে চাচ্ছে। শুধু এটাই একমাত্র কারণ নয়। প্রতিমাশিল্পীরা জানিয়েছেন, তাদের বাবা ঠাকুর্দার পেশায় বর্তমান প্রজন্মের না আসার আরও অনেক কারণ আছে। যেমন সারা বছর ধরে খেটেও প্রয়োজনীয় পারিশ্রমিক মেলে না। দুর্গাপুজোর সময় জলপাইগুড়ি শহরে ক্লাবগুলি প্রতিমা তৈরির জন্য বরাত দিয়ে যায়। তখন একরকম দাম ঠিক হয়। আর প্রতিমা নেওয়ার জন্য যখন আসে তখন সেই দাম তারা দেয় না বলে তাঁদের দাবি। ঝামেলা হলে তখন পাশে রাজনৈতিক দল থেকে আরম্ভ করে পুলিশ প্রশাসনকেও কাছে পাওয়া যায় না। তাঁদের কথায়, ‘‘প্রতিমা তৈরির সরঞ্জামের দাম প্রতিদিন বেড়ে চলেছে। পাল্লা দিয়ে প্রতিমার দাম বাড়ছে না। প্রতিমা তৈরির জন্য কোনও ঋণপ্রকল্প নেই। ঘরের টাকা জমিয়ে কাজ করতে হয়।’’
তবে জলপাইগুড়ি পুলিশের ডিএসপি প্রভাত চক্রবর্তী বলেন, ‘‘আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করা হলে নিশ্চয়ই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’ তিনি বলেন, ‘‘প্রতিমার বায়না করার সময় একটি লিখিত চুক্তি করে নেওয়া উচিত। তা হলে এই সমস্যা এড়ানো যায়।’’ তৃণমূলের জলপাইগুড়ি জেলা সহ সভাপতি চন্দন ভৌমিক বলেন, ‘‘আমাদের কাছে এতদিন বিষয়টি কেউই জানায়নি।’’
তবে জলপাইগুড়িতে বড় পুজো করে এমন ক্লাবগুলি সাধারণত বাইরে থেকেই প্রতিমা আনান। ছোট ক্লাবগুলির ক্ষেত্রেই এই সমস্যা তৈরি হয় বলে শহরের মানুষের ধারণা।
জলপাইগুড়ি শহরের জলপাইগুড়ি মৃৎশিল্পী সমিতি সুত্রে জানা যায় যে, সমিতির ৩৮ জন সদস্যের মধ্যে দু’জনের কারখানা বন্ধ। সেই দুজন হলেই নিতাই পাল এবং রঞ্জিত বর্মন। নিতাই পাল প্রয়াত। পরবর্তী প্রজন্ম তাঁর কারখানা ধরে রাখতে পারেনি। রঞ্জিত বর্মনের কারখানা লোকের অভাবে বন্ধ। বাকি যারা আছেন তাদের অধিকাংশের বয়স পঞ্চাশের উপরে। তাদের পর আর কে এই শিল্পকর্ম ধরে রাখবে, সেটাই এখন প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়েছে।
জলপাইগুড়ি শহরে সবচেয়ে বয়স্ক মৃৎশিল্পী হলেন নরেন পাল। ৭৬ বছর বয়সের এই শিল্পী এখনও প্রতিমা গড়ে চলেছেন। নরেনবাবু পুরুষানুক্রমে শিল্পী। এক সময় বর্তমান বাংলাদেশের বিক্রমপুরের শ্রীনগর গ্রামে তাদের বাড়ি ছিল। মাত্র নয় বছর বয়সে বাবা মার সঙ্গে জলপাইগুড়িতে চলে আসেন। বাবার কাছেই কাজে হাতেখড়ি। জলপাইগুড়ি শহরের কামারপাড়ায় প্রথম কারখানা ছিল। তারপর স্টেশনপাড়ার নরেনভিলায় কারখানা গড়েন। এখন তেলিপাড়া এবং সেবাগ্রামে দুটি কারখানা করেছেন। নরেনবাবু বলেন, “আমাদের বংশে আমিই শেষ শিল্পী। আমার ছেলে এমকম পাশ করে এখন গৃহশিক্ষকতা করে টাকা রোজগার করে। পড়াশোনার দিকে ঝোঁক থাকায় এই শিল্প শেখেনি।”
পশ্চিম অরবিন্দ নগরের জীবন পালের বয়স এখন পঞ্চাশ। তিনি তাঁর বাবা প্রয়াত হরেন পালের কাছে কাজ শিখেছেন। গত ৩০ বছর ধরে প্রতিমা বানাচ্ছেন। তাঁর তিন ছেলে ও এক মেয়ে। বড় ছেলে অনুষ্ঠানে পালা পার্বণে ভিডিও ফটোগ্রাফি করে। মেজ ছেলে প্রতিমার সাজসরঞ্জামের দোকান করেছে। আর ছোট ছেলে এগারো ক্লাসে পড়ে। সে পড়াশোনা করবে বলে ঠিক করেছে। জীবনবাবু বলেন, “আমার পরে এরা কেউই আর প্রতিমা বানাবে না। কারণ কারোরই তেমন কোনও ইচ্ছে নেই। ওরা দেখেছে মুর্তি বানানোর জন্য আমরা কোনও সরকারি সাহায্য পাই না। মূর্তি নেওয়ার সময় ক্লাবগুলোর সঙ্গে ঝামেলা বাধে। এ সব দেখেশুনে এই শিল্পে আসতে আমার ছেলেরা কেউ আগ্রহী নয়।”
একান্ন বছর বয়সী সুভাষ পালের আদিবাড়ি অসমের বিলাসিপাড়ার বগরিবাড়ি গ্রামে। বাবা প্রয়াত নিতাই পালের কাজ শিখেছেন। জলপাইগুড়ি শহরে কাজ করছেন ২৫ বছর। জলপাইগুড়ি শহরে প্রথমে একজন শিল্পীর কারখানায় কাজ করতেন। এখন নিজে কারখানা গড়েছেন। সুভাষবাবুর এক ছেলে এবং এক মেয়ে। দুজনেই পড়াশোনা করে। সুভাষবাবুর আক্ষেপ, “প্যান্ডেলের জন্য পুজো কমিটিগুলি লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে। সেই তুলনায় প্রতিমার খরচ কিছুই না। অথচ সেই টাকা দিতে পুজো কমিটিগুলো ঝামেলা করে। আমার ছেলেমেয়েরা এই পেশায় আর আসবে না।”
রতন পাল এবং অনিল পাল দুই ভাই মিলে দু’টি কারখানা চালান। একটি পুরাতন পুলিশ লাইনের কাছে। অন্যটি নেতাজিপাড়ায়। রতন পাল নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ে এই পেশায় আসেন। প্রৌঢ় এই শিল্পী বলেন, “রাজ্যে আমরাই হচ্ছি আসল শিল্পী। বংশানুক্রমিকভাবে আমরা এই কাজ করে চলেছি। আমরা এখন আস্তে আস্তে অবলুপ্তির পথে। রাজ্য সরকার লুপ্তপ্রায় প্রাণীদের বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ আমাদের বাঁচানোর জন্য কোনও পরিকল্পনা নেই। এমনকি দুর্গাপ্রতিমা বানানোর সময় যে টাকা লাগে, সেই টাকার ঋণ আমরা কোথাও পাই না। আগামি ১৫ বছরের মধ্যে রাজ্যের মৃৎশিল্পীরা হারিয়ে যাবে।” এই বক্তব্য শুধু এই কজন শিল্পীর নয়, জলপাইগুড়ির অধিকাংশ মৃৎশিল্পীর বক্তব্য একই।