চলছে চা-ফুল বাছাইয়ের কাজ। নিজস্ব চিত্র
হালকা কুয়াশা থাকলেও ঘড়িতে বেলা অনেক। চা বাগানের মাঝখানে এক চিলতে মাঠ। পাশ দিয়ে শ্রমিক বস্তির দিকে চলে যাওয়া কয়েকটি কংক্রিটের রাস্তায় কয়েকটি মুরগি ধুলো ঠুকরে খাবার খুঁজছে। ইতিউতি দু’একজন বসে। এতটাই নিঃশব্দ চারিদিকে যেন পাতা পড়লেও শোনা যাবে। বাগানের অনেক এলাকায় পাতা তুলতে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। মোবাইলে কথা থামিয়ে এগিয়ে এলেন বিশু সাওয়াসি। বললেন, “লোক কোথায়! সকালের গাড়িতেই সকলে চলে গিয়েছে।”
জলপাইগুড়ি শহর লাগোয়া বন্ধ রায়পুর চা বাগানে এখন রুজি দিচ্ছে এই ‘সকালের গাড়ি’ই। পুজোর আগে মালিকপক্ষ বাগান ছেড়ে চলে গিয়েছে। তারপর থেকে মজুরি বাকি। শ্রমিকেরা নিজেরা পাতা তুলে বিক্রি করেন। কিন্তু তার দরও অনেক কম। যা টাকা হয় তা শ্রমিকদের মধ্যে ভাগ হয়। তাও অনিয়মিত। তাই শ্রমিকদের কারও ভরসা একশো দিনের কাজ, কারও এই ‘সকালের গাড়ি’।
প্রতিদিন ভোরে রায়পুর চা বাগানে পরপর আসতে শুরু করে পিকআপ ভ্যান, যা পরিচিত ‘সকালের গাড়ি’ নামে। পাঠান স্থানীয় শ্রমিক ঠিকাদারেরাই। তাতে নাম লিখিয়ে শ্রমিকেরা উঠে পড়েন। গাড়ি যায় জলপাইগুড়ির চড়কডাঙ্গি, পাঙ্গা, ময়নাগুড়ি রোড, বেলাকোবা, ধূপগুড়িতে। কোনও গাড়ি যায় আলু খেতে, কোনও গাড়ি মটরশুঁটির জমিতে। দু’টি পাতা একটি কুঁড়ি তুলতে অভ্যস্ত হাতগুলি ব্যস্ত হয়ে পড়ে কোথাও আলু খেতে, কোথাও কড়াইশুঁটির বীজ বুনতে। জেলাশাসক শিল্পা গৌরীসারিয়া জানিয়েছেন, বাগান স্বাভাবিক করতে মালিকের সঙ্গে আলোচনা চলছে। বাগানের গুদাম লাইনের বাসিন্দা লক্ষ্মী মুন্ডা বললেন, “মা টিবিতে আক্রান্ত। বাগানে যখন কাজ নেই, বাইরেই যেতে হচ্ছে। আগে পাতা তুলতাম, এখন আলু বুনছি।” মংলা রজক বললেন, “আমার পরিবার তো একশো দিনের কাজের টাকাতেই চলছে। তবে প্রতিদিন মজুরি মেলে না। যে দিন টাকার খুব প্রয়োজন হয় সেদিন সকালের গাড়িতে উঠে যাব।” বন্ধ রায়পুর চা বাগানের শ্রমিকেরা এ ভাবেই বিকল্প রুজি খুঁজে নিয়েছেন।
শীতের শুরুতে আলু থেকে অন্য আনাজ বুনতে প্রচুর শ্রমিক প্রয়োজন হয়। মাঠে বীজ বপণের পর পরিচর্যা, তোলা সব মিলিয়ে মাসখানেক এই চাহিদা থাকে। তাতেই ভরসা পাচ্ছে রায়পুর বাগান। চা বাগানের শ্রমিকদের মজুরি ১৯০ টাকা। খেতে কাজ করতে গেলে মেলে ১৬০ টাকা। বুধবার বাগানে দাঁড়িয়ে কাংলু ওঁরাও বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে পাতা তোলা শ্রমিকদের পক্ষে খেতের কাজ করতে প্রথমে দিকে কষ্ট হত, তবে সকলেই সে সব কাজ শিখে নিয়েছেন।’’
তবে সবার ভাগ্যে অবশ্য কাজ জুটছে না। বয়স্ক, রোগে আক্রান্ত অনেক শ্রমিকই খেতের কাজে যেতে পারেন না। একশো দিনের কাজও তাঁদের দ্বারা সম্ভব হচ্ছে না। সেখানে অনটন নিত্যসঙ্গী বলেই অভিযোগ। কারখানা লাইনের এমনই এক শ্রমিক পরিবারের রাধা মুন্ডা বললেন, “সরকারি চাল ফুটিয়ে গলাভাত ও চা ফুল ভাজা খাচ্ছি। কখনও মুখ বদলানোর জন্য শাক সেদ্ধ ভরসা।’’ জেলাশাসক অবশ্য বলেন এমন শ্রমিকদের খোঁজে সমীক্ষা হচ্ছে। তাঁদের জন্য আপৎকালীন ভাতার ব্যবস্থা করা হবে।