শিলিগুড়ির পথে ত্রাণ সংগ্রহ করছেন বৃহন্নলারা। সোমবার সন্দীপ পালের তোলা ছবি।
অভ্যেস মতো ওঁদের কেউ কেউ হাতে তালি বাজিয়েছে। কেউ বা কমবয়সী পথচারীদের আদুরে গলায়, ডেকে ফেলল, ‘‘অ্যাই, এ দিকে একবার দেখ গো।’’ কারও হাতে সাদা কাগজে মোড়া কৌটো, কারও হাতে ধরা পোস্টারে লেখা, ‘‘সবদিন আমাদের জন্য চেয়েছি, আজকে ভূমিকম্প পীড়িত পরিবারের সাহায্যের জন্য চাইছি।’’ দুপুরের চড়া রোদে শিলিগুড়ির হিলকার্ট রোড দিয়ে হেঁটে চলেছেন বৃহন্নলাদের দল। নেপালের ভূমিকম্প দুর্গতদের সাহায্য সংগ্রহের জন্য শিলিগুড়ির পথে নেমেছে মালদহ, আলিপুরদুয়ার থেকে আসা বৃহন্নলারা। নিউ জলপাইগুড়ি (এজেপি) স্টেশন লাগোয়া এলাকায় আগে থেকেই জড়ো হয়েছিলেন শিলিগুড়ির সকলে। সোমবার সকাল দশটা নাগাদ এনজেপি থেকে শুরু হয় ত্রাণ সংগ্রহ। দেশবন্ধ পাড়া, উড়ালপুল, হাসমিচক থেকে কোর্ট মোড় হয়ে ফের হিলকার্ট রোড ঘুরে সেবক রোডেও দিনভর ত্রাণ সংগ্রহ করেছেন তাঁরা।
গত এক সপ্তাহ ধরে ভূমিকম্প বিধ্বস্ত নেপালের জন্য ডান-বাম বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের কৌটো হাতে, ঝোলা নিয়ে ত্রাণ সংগ্রহ করতে দেখেছেন শিলিগুড়িবাসী। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে, সামাজিক নেটওয়ার্কিং সাইটেও পেশাদারি সংস্থার সাহায্যের কেতাদুরস্ত আবেদনও চলছে। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলিও ত্রাণ সামগ্রী জোগাড় করতে শিলিগুড়ির পথে নেমে আবেদন নিবেদনও দেখে চলছেন বাসিন্দারা। তবে এ দিন ত্রাণ জোগাড়ে বৃহন্নলাদের রাস্তায় দেখে আবাক হয়েছেন অনেকেই। একটি বেসরকারি মোবাইল সংস্থার শিলিগুড়ি অফিসের আধিকারিক দীপ্তনীল বসু হিলকার্ট রোডে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘‘ওঁদের দেখলেই আমরা মুখ ঘুরিয়ে নেই, কেউ বা বিদ্রূপ করি। ওদেরকে আমরা অনেকেই নিজেদের সমাজের অংশ মনেই করি না। তবে ওঁরা সকলের কথা ভাবেন বলেই ত্রাণ জোগাড়ে বেরিয়েয়েছেন। ওঁদের কাছ থেকে শেখার রয়েছে।’’
রাস্তায় প্রায় মিছিলের আকারে বৃহন্নলাদের হাততালি দিয়ে যেতে দেখে অনেকে ব্যবসায়ীরাই আশঙ্কা করেছিলেন, এই বুঝি ‘উপদ্রব’ শুরু হল। তবে পোস্টার, ব্যানার দেখে তাঁরা তাজ্জব বনে যান। সামনে একটি ফ্লেক্স, তাতে ভূমিকম্প বিধ্বস্ত নেপালের নানা ছবির কোলাজ। ত্রাণ চেয়ে আবেদন লেখা। নীচে সৌজন্যে ‘উত্তরবঙ্গ কিন্নর (হিজড়ে) লোকাল কমিটি’। সোমবার শিলিগুড়ির পরে, আজ মঙ্গলবার, কোচবিহার এবং তারপরে আলিপুরদুয়ার, ধূপগুড়িতে চারদিন ধরে ত্রাণ জোগাড় করবে কমিটি। তারপরে দার্জিলিং জেলাশাসকের হাতে সেই ত্রাণ তুলে দেওয়া হবে বলে জানালেন শিলিগুড়ি কমিটির মুখপাত্র কাজল রায়।
এ দিন যাঁরা ত্রাণ জোগাড়ে হেঁটেছেন, আগে কোনদিন টাকা জোগাড়ে রাস্তায় নামেননি বলে জানালেন। বিভিন্ন ট্রেনের যাত্রীদের থেকেই তাঁরা নিজেদের জন্য টাকা সংগ্রহ করেছেন। কাজল বললেন, ‘‘একদিন টিভিতে নেপালের ভূমিকম্পের ছবি দেখে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। দেখলাম কত বাচ্চা অনাথ হয়ে গিয়েছে। খুব কান্না পাচ্ছিল জানেন, তারপর সকলকে ডেকে বললাম, কেউ না করল না।’’ এনজেপি এলাকার বাসিন্দা শিবানীর কথায়, ‘‘ত্রাণ সংগ্রহ করব জেনেই মালদহ, আলিপুরদুয়ারে আমাদের যাঁরা রয়েছেন, সকলে ট্রেন ধরে চলে এসেছেন।’’
শিলিগুড়ির রহিমা, কালী, সোনালি, রানি আলিপুরদুয়ার থেকে আসা করুণা, সীমা, জয়া, মালদহের নিকিতা, দীপিকা, উজালা-রা কখনও রাস্তার ধারের দোকানে, কখনও বা পথচলতি বাসিন্দা, সিগন্যালে দাঁড়ানো গাড়ি, অটোতে থাকা যাত্রীদের থেকে ত্রাণ সংগ্রহ করেছেন। শিলিগুড়ি-কোচবিহার-ধূপগুড়িতে গিয়ে ত্রাণ সংগ্রহ করা, খাওয়াদাওয়ার খরচাও রয়েছে। তার জন্য নিজেরা সকলে প্রথমে ৫০০ টাকা করে জমা করেছেন। রানির কথায়, ‘‘নিজেরা প্রথমে জমা করেছি, সেগুলি দিয়ে আমাদের চারদিনের খাই খরচা মেটাবো। সংগ্রহ করা ত্রাণের এক টাকাও নিজেদের জন্য খরচ করা যাবে না। তাতে অভিশাপ লাগবে যে!’’