মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হল সম্প্রতি। প্রাপ্তির ভাঁড়ার বলতে বানানবিধি নিয়ে নির্দেশিকা ও তার ট্রোলের বন্যা সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে। সেই বাতাবরণের মধ্যেই শুরু হল উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা। আমরা জানি, জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাঁক এই পরীক্ষা থেকেই। এই পরীক্ষাকে ভিত্তি করেই তরুণ শিক্ষার্থীদের ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-গবেষক হওয়ার ছাড়পত্র আদায় করে নিতে হবে নানান সর্বভারতীয় পরীক্ষা বা কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাডমিশন টেস্ট দিয়ে। আমরা জানি, এই পরীক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ বিভিন্ন নামী কোচিং সেন্টার থেকে তৈরি হচ্ছেন সেসব মোকাবিলা করতে, একটা বড় অংশ আবার পরের একটা বছর ধরে রেখেছেন শুধু কোচিংয়ের জন্য। যদি না লাগে দান, তবে জেনারেল লাইন। তার জন্য উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্টটা ঠিকঠাক করে রাখতে হবে, তাই চাপ নিয়ে পড়াশুনো।
এই বঙ্গদেশে অবশ্য কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়স্তরে জেনারেল লাইনে পড়তে গেলে সঠিক পরিকাঠামো ও শিক্ষাদান ব্যবস্থা কলকাতাকেন্দ্রিক গুটিকয় প্রতিষ্ঠানের বাইরে একদম গড্ডালিকা প্রবাহ। বিজ্ঞান বিভাগে যারা এই উচ্চশিক্ষায় নিজেদের নিয়জিত করবেন, তাদের জন্য অনেক জেলা সদরের কিছু নামী কলেজ মোটামুটি একটা পরিকাঠামো, ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত হোক বা ল্যাবরেটরির মান, দিতে সক্ষম কিন্তু কলা ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের জন্য একদম শূন্য ভাড়ার।
সময়াতীত কাল থেকেই সাধারণভাবে আম বাঙালির পড়াশুনার জোর অঙ্ক ও বিজ্ঞানকেন্দ্রিক। তার বাইরে শুধুই ইংরেজি। বাঙালীর ইংরেজি মাধ্যমের প্রতি প্রীতির কারণ, যতটা না শিক্ষার্থীকে উন্নত পরিকাঠামো উপহার দেওয়ার প্রয়াস, তার চেয়েও বেশি সন্তানকে ইংরেজি বলতে দক্ষ করে তোলার অভিপ্রায়। আর মাধ্যম বাংলা হোক বা ইংরেজি, খুব ছোট থেকেই আমাদের সন্তানরা শিখে যায়, অঙ্ক-বিজ্ঞানকে বুঝতে হবে, ইংরেজিটা শিখতে হবে, আর সাহিত্য ও সমাজবিজ্ঞান শুধু পড়তে হবে আর মুখস্থ করতে হবে। মাধ্যমিকস্তর পর্যন্ত এভাবে চালিয়ে যেতে পারলে খুব যে একটা অসুবিধে হয় তাও নয়। কিন্তু সমস্যাটা শুরু হয় উচ্চমাধ্যমিক থেকে এবং প্রকট হয় কলেজস্তরে। কেবল ওই গুটিকয়েক প্রিমিয়ার প্রতিষ্ঠানকে বাদ দিলে।
মফস্লের স্কুলগুলিতে কলা বিভাগে অগণিত ছাত্রছাত্রী ভর্তি নেয় বা নিতে বাধ্য হয়। কলেজগুলিতেও সাধারণ কোর্সেই শুধু নয়, সাম্মানিকস্তরেও এখন শতাধিক করে আসন রাখা থাকে কলা ও সমাজবিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে। আসলে কলা ও সমাজবিজ্ঞান পড়ানোর জন্যও যে পরিকাঠামো দরকার, ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত এবং প্রকৃতভাবে পড়ানোর আঙ্গিক তা শিক্ষা-নিয়ন্ত্রক থেকে শিক্ষক, অভিভাবক বা ছাত্র অনেকেরই নেই।
সাধারণ একটা ধারণা, ইতিহাস (বা ভূগোল) আবার বোঝার কি আছে? এই ধারণা তৈরির পিছনে আমাদের মতো সাহিত্য ও সমাজবিজ্ঞানের একটা বড় অংশের শিক্ষকেরাও দায়ী। একটা টেক্সট যে একটা গল্প নয়, শুধু যেটা পড়িয়ে গেলেই সিলেবাস শেষ ও শিক্ষক দায়মুক্ত, সেই বার্তাটা স্কুল-কলেজের সাহিত্য ও সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষকেরা জোরালোভাবে করেন না। আসলে একটা টেক্সট যে বিভিন্ন চিন্তা, চেতনা ও মতবাদকে মেলে ধরার সূত্র, সেটা অবহেলা করে শুধু গল্পটার বা ঘটনার সারাংশ বলা হয় বেশিরভাগ সাহিত্য ও সমাজবিজ্ঞানের ক্লাসে। ছাত্ররা নিয়মিত নয়, ওই নোট মুখস্থ করে লিখবে, এই সব ধারণা থেকে আমরা শিক্ষকেরা আমাদের হাতে পাওয়া সুযোগগুলোকে নষ্ট করি। ইতিহাসের মতো একটা বিষয় শুধু ঘটনাক্রম বলে যাওয়ার ক্লাস হয়, মাধ্যমিকস্তর থেকে উচ্চমাধ্যমিক এবং কলেজস্তরেও মোটামুটি ৯০ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে। আমি সেই বাংলার মাস্টারমশাইকে দেখিনি কিন্তু গল্প শুনেছি। তিনি কলেজের পাসকোর্সের ক্লাসেও কপালকুণ্ডলা পড়াতে গিয়ে শকুন্তলা তার সঙ্গীদের থেকে যে যৌন চেতনাবোধ জাগ্রত করেছিল, সেই চেতনার অভাবে কপালকুণ্ডলা কীভাবে পণ্যায়িত হয়েছিলেন তার ব্যখ্যা করতেন। চাইলে তিনিও গল্প বলেই ক্লাস শেষ করতে পারতেন। কিন্তু করেননি। ইংরেজির অধ্যাপক চাইলে ম্যাকবেথের ডাইনিদের ডাইনি হিসেবে পড়িয়েও ক্লাস থেকে চলে যেতে পারেন। বা চাইলে পড়াতেই পারেন যে ওই ডাইনিরা আসলে স্কটল্যান্ডের সেই প্রান্তিক মানুষেরা যারা স্কটল্যান্ডের রাজনীতিকে একটু প্রভাবিত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এই দ্বিতীয় পথের জন্য শুধু শিক্ষকের সদিচ্ছা থাকলেই হবে না, পরিকাঠামো ও পরিবেশ থাকতে হবে পড়ানোর। যেটা নেই এবং নেই বলে যে ছাত্রছাত্রীরা বঞ্চিত হচ্ছে সেই হাহাকারটাও নেই। অনিয়মিত হাজিরা দেওয়া ছাত্র, আর ছাত্ররা এলে ক্লাসঘর গোয়ালঘর হয়ে যাওয়া এসবের মাঝে দাঁড়িয়ে শিক্ষকেরা শুধু গল্প বলে সিলেবাস শেষ করার দায়মুক্ত হচ্ছেন, কারণ তারাও মেনে নিচ্ছেন যে ছাত্ররা তো শেষ পর্যন্ত ওই নোটটাই মুখস্থ করবে, ওটাই ওগড়াবে পরীক্ষার খাতায়, আর নম্বর প্রচুর দেওয়ার দায়ও শিক্ষকেরই কাঁধে। প্রান্তিক শহর ও মফস্বলের উচ্চমাধ্যমিকস্তর ও কলেজগুলি এভাবেই সাহিত্য ও সমাজবিজ্ঞানের আগামিদিনের শিক্ষক ও গবেষক তৈরি করছে, এদের মধ্যেই কিছু ছাত্রছাত্রী হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়স্তরে গিয়ে নিজের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে পারবে। কিন্তু মধ্যমেধার চর্চার এই গণ্ডি অনেক সম্ভাবনাকেও নষ্ট করবে। সেটাও বাস্তব, যদিও এই গড্ডালিকা প্রবাহের উল্টোপথটাও আমরাই বেছে নিতে পারি।
( লিখছেন কোচবিহার ইউনিভার্সিটি বিটি অ্যান্ড ইভনিং কলেজের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক)