এ প্রিন্স
তখন কলেজে চাকরি করি। সম্ভবত ১৯৬৯। বালুরঘাট কলেজের অধ্যক্ষ সুধীরকুমার করণ, অধ্যাপক অতুল চক্রবর্তী, অধীর দাস, উত্পল চৌধুরী মিলে দার্জিলিঙে বেড়াতে যাই। তখন শান্ত, স্নিগ্ধ, মনোরম দার্জিলিঙের পরিবেশ। ম্যালে গিয়ে অতুলবাবু ঘোড়ায় চাপেন। রোদ থাকায় গায়ে জড়ানোটি খুলে শাল মাথায় পাগড়ির মতো বেঁধে নিলেন তিনি। তা দেখে সুধীরবাবু বলে ওঠেন, ‘‘অতুল তোমাকে তো মহারাজের মতো দেখাচ্ছে!’’ অতুলবাবু বলে ওঠেন, ‘‘আই অ্যাম এ প্রিন্স।’’ তখন টাইগার হিলে শৌচাগার ছিল না। ফলে পরদিন সেখানে গিয়ে অসুবিধায় পড়তে হয়েছিল আমাকে। কিন্তু গোটা বেড়ানোটা মন ভরিয়ে দিয়েছিল। পরেও একবার দার্জিলিঙে যাই। তখন গন্ডগোল বলতে কিছুই ছিল না। সে সব পুরনো কথা মনে পড়লে এখন খারাপ লাগে। এখনকার এই গোলমালের সঙ্গে তা মেলাতে পারি না।
হরিমাধব মুখোপাধ্যায়, নাট্যকার, বালুরঘাট
আগুন নয়
বছর ছয়েক আগে সেখানে গিয়েছিলাম। আমার সঙ্গে ছিল চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের একটি দল। সোনাদায় স্বাস্থ্য শিবির করতে যাই। ছোট্ট রেল লাইন একে বেঁকে উঠে এসেছে। স্টেশনটা দেখেই মন ভাল হয়ে গেল। কী শান্ত, অথচ প্রাণচঞ্চল একটা শহর। মাত্র কয়েক ঘণ্টা ছিলাম। তাতেই যেন সারা জীবনের ভাললাগা তৈরি হয়ে গেল। সে দিন দেখলাম, ওই সোনাদা স্টেশন দাউ দাউ করে জ্বলছে! থানা ভাঙা হয়েছে। কুয়াশা নয়, কালো ধোঁয়ায় ঢেকেছে আমার ভাললাগার শান্ত জনপদটা। রাজনীতি নিয়ে আমার কোনও মন্তব্য নেই। তবে যাঁরা আগুন জ্বালিয়েছেন, তাঁদের অনুরোধ করছি, দয়া করে হিংসা বন্ধ করুন। আমাদের সকলের শান্ত পাহাড়কে ফিরিয়ে দিন। কালো ধোঁয়া নয়, পাহাড়ে থাকুক চির-শরৎ।
আশিস দাশগুপ্ত, শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ, ইসলামপুর
এখনও যন্ত্রণা
কলেজের পরীক্ষা শেষে প্রথম দার্জিলিং যাই। সেই মুগ্ধতা এখনও মনে লেগে রয়েছে। তার পরে অজস্রবার সেখানে গিয়েছি। যখন হেরিটেজ কমিশনের একটি প্রকল্পের দায়িত্বে ছিলাম, সে বারও গিয়েছি। কত হেরিটজ ভবন, পুরনো রাস্তা খুঁজে পেয়েছিলাম সে বার। পরিবারের সঙ্গেও দার্জিলিং গিয়েছি। ম্যাল, চৌরাস্তা তো আছেই, সেই সঙ্গে দার্জিলিঙের লাইব্রেরি আমাকে খুব টানে। রাজভবনের সামনের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতেও দারুণ লাগে। এখন পরিস্থিতি বদলে গিয়েছে। সমস্যাও একদিনে তৈরি হয়নি। বীজ বপন হয়েছিল বহু আগে। এর আগের সরকার এর দায় এড়াতে পারেন না। যে দিন সুবাস ঘিসিঙ্গের স্ত্রীর মরদেহ দার্জিলিঙে উঠতে বাধা দেওয়া হয়েছিল, সে দিন প্রশাসন চুপ করে বসেছিল কেন? এ সব প্রশ্ন আমাকে এখন যন্ত্রণা দেয়। তবে একটা বিষয় পরিষ্কার, গোর্খাল্যান্ডের স্বপ্ন পাহাড়বাসীর হৃদয়ে। ছোটবেলা থেকে দার্জিলিঙের আন্দোলন দেখছি তো। তাই বলতে পারি, আজকের পরিস্থিতি কিন্তু বিমল গুরুঙ্গ থাকলেও হতো, না থাকলেও হতো।
আনন্দগোপাল ঘোষ, উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রাক্তন প্রধান
রেখার স্মৃতি
দার্জিলিং, আমার কাছে কোনও দিনই শুধু মন ভোলানো রূপ নয়, আমার কাছে সে বিরাট হৃদয় ও শিশুর মতো উদ্দাম কিছু আলোছায়া মাখা মানুষের কথাও। এই পাহাড় কথায় আছেন একজন আকাশের মত চিত্তের শেরপা বনরক্ষী, আবার রয়েছে সম্প্রীতির জন্য কলিজা উজার করা সপ্তদশী স্কুলছাত্রী। পাহাড়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক যদিও জন্মাবধি। ঠাকুরদা ছিলেন ডাক বিভাগের কর্মচারী। পোস্টিং ছিল দার্জিলিং। পরে মেজ জ্যাঠাও সেখানেই কাজ করেন। ফলে শৈশব থেকেই পাহাড় আমার দ্বিতীয় আবাস। ১৯৮৬-এর এপ্রিলে অশান্ত সময়েরও সাক্ষী ছিলাম আমি। পাহাড়ের সেই সপ্তদশী ছাত্রীটির রক্তাক্ত ও প্রাণহীন দেহ এখনও চোখে ভাসে। তাকে নিয়েই আমার তৃতীয় কবিতার বই। রেখা তামাঙ্গ। তার কথা মনে পড়ছে খুব।
গৌতম গুহরায়, কবি
শান্ত হোক
‘বাংলা ভাগ হতে দেব না’— এটা এমন একটা স্লোগান যা ৯৯ শতাংশ বাঙালি সমর্থন করেন। ক্ষমতাসীন দল সেটাকেই সামনে রাখে। কেউ বিরোধিতা করলেই রাষ্ট্রদ্রোহী হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। পাহাড়ের বিশিষ্টজনেরাও যদি আন্দোলনের নামে ভাঙচুর, হেরিটেজ সম্পত্তি পোড়ানোর বিরুদ্ধে কথা বলেন, তা হলে জাতিবিদ্বেষী বলে তাঁদের গায়ে তকমা সেঁটে দেওয়া হতে পারে। মাঝে সব শান্ত ছিল, আবার জেগে উঠেছে। দ্রুত আলোচনায় বসে সমাধান করতে হবে। ‘আপাতত’ এটা দিলাম, পরে দেখা যাবে গোছের নয়। স্থায়ী সমাধান করতে হবে। তা না হলে এমন পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা থেকেই যাবে।
বিপুল দাস, কথা সাহিত্যিক