আজ খেলা ভাঙার খেলা খেলবি আয়, / সুখের বাসা ভেঙে ফেলবি আয়।
রবীন্দ্রনাথের এই কবিতা যেন শাসকের শৃঙ্খল, আবর্ত, ও আবদ্ধতা ভেঙে মুক্তির আলো দেখাতে চেয়েছে। তিনি মনে করতেন যে শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যই হল আত্মার মুক্তি। একবিংশ শতাব্দীতে শিক্ষার হার উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েছে। তাই তো কবিগুরুর সেই গানকে আবার নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। উৎসবের আবেগঘন মুহূর্তগুলিতেও।
এটাই তো সময় উত্তর-উপনিবেশবাদ-তাত্ত্বিক গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের ‘স্ট্রাটেজিক এসেনসিয়ালিজম’-কে শুভলগ্নে সুপ্রতিষ্ঠিত করবার। প্রতি বছর শারদোৎসবের সময় পূজিতা দেবী দুর্গা নারীশক্তির আধার। মা দুর্গার মূর্তি অস্ত্র-সজ্জায় সজ্জিত শক্তিরূপী নারী। একদিকে শ্রীবৃদ্ধিকারী মা লক্ষ্মীর মূর্তি। আর অপরদিকে সৃজনশীলতা আর জ্ঞানবৃদ্ধির প্রতীক দেবী সরস্বতী। তিন নারীমূর্তির সুদৃঢ় উপস্থিতিতে নারীর ক্ষমতায়নের ও মাতৃত্বের ধারক-ও-বাহক এই মা দুর্গাই। যা প্রতিটি নারীরূপকে প্রতি মুহূর্তে তার সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। সমাজে নারীরা আর কেবলই ‘অপর’ বা ‘প্রান্তিক, দলিত মানুষ’ না। যুগযুগ ধরে চলে আসা সমাজের বিভিন্ন ‘স্টিরিওটাইপ’ ও ‘ট্যাবু’ ভাঙার সময় বোধহয় এসেছে। তাই তো দশমীর পুণ্যলগ্নে অবলীলাক্রমে সকল শ্রেণির নারীরা, দুর্গারূপীরা, মেতে উঠতে পারেন সিঁদুর-খেলায়। উত্তরবঙ্গের নারীরা, তথাকথিত ‘বিধবা’-রা, ও রূপান্তরকামীরাও তার ব্যতিক্রম নয়।
সিঁদুর—এক প্রগলভ রশ্মি-রং। শক্তির রূপ। সৌন্দর্যবর্ধক প্রসাধন। কিন্তু হিন্দু শাস্ত্রমতে এই সিঁদুর স্থান পায় শুধু বিবাহিত নারীর সিঁথিতে। কুমারীরা কপালে টিপ-আকারে সিঁদুর পরতে পারলেও, তা সিঁথিতে দেওয়া নিষেধ। আবার বিধবার সব রং কেড়ে নেওয়া হয়। তাকে সাদা বস্ত্র পড়ানো হয়। যেন তাকে বারবার স্মরণ করানোর জন্য যে ওই নারী কেবল একজন, সেই মৃত পুরুষেরই ভোগপণ্য বা সম্পত্তি ছিল। তার স্বকীয়তা, সৌন্দর্য, জীবনবোধ। সবটাই ছিলো ওই স্বামীরূপী পুরুষ-নির্ভর। যদিও প্রাচীনকালে পুষ্পদন্ত এবং আদি-শঙ্করাচার্য “সৌন্দর্যলহরী”-গ্রন্থে যুগ্মভাবে বলেছেন যে সিঁদুর নিতান্তই নারীর সৌন্দর্যবর্ধক প্রসাধন মাত্র।
ইতিহাসের বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় যে সিঁদুরের আবিষ্কার হয় প্রাচীন চিনে। পূর্বে নারী-পুরুষ উভয়েই সিঁদুরকে মস্তক-কেশ-রঞ্জক হিসাবে ব্যবহার করতেন। পরে ক্রমশ তা নারীর প্রসাধনী হিসাবে মান্যতা পায়। আজকের মেয়েরা পেরেছে নানা ক্ষেত্রে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বেড়াজাল আর নিয়মের রক্তচক্ষু ভেঙে বেরিয়ে আসতে–‘নারীত্ব’ নামক শৃঙ্খলকে টুকরো করে মুক্ত মনে ভাবতে। উত্তর-আধুনিক সমাজে ইঙ্গিতবহতার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই দক্ষিণবঙ্গে বা উত্তরবঙ্গে পালটে গিয়েছে সিঁদুরের ব্যবহার, বা এর অর্থ। উত্তর-নারীবাদীরা মাঝে-মাঝে বলেন বটে যে সিঁদুর নারীর দাসত্বের প্রতীক। অথচ এটি তো এ ভাবেও দেখা যেতে পারে, যে সিঁদুরকে সাধারণত নারীর দুর্বলতার অংশ হিসেবেই দেখা হয়, সেটা নারীর এক বিশেষ শক্তি। নারীশক্তি, নারীমুক্তির-প্রতীক মা দূর্গাকে সাক্ষী রেখে অবলীলাক্রমে, সদর্পে সিঁদুর খেলায় মেতে ওঠেন মেয়েরা। চারিদিক ঢাকা পড়ে সিন্দুরের রক্তিম আভায়। সেই লাল রং, যা নারীর অন্তরাত্মার শক্তিকে প্রতি মুহূর্তে জাগ্রত করে, তা উত্তর-দক্ষিণ নির্বিশেষে পুরুষকে ঠেলে দেয় ক্ষমতাস্খলনের এক প্রান্তিকতায়। সিঁদুরখেলার মত্ত-প্রাঙ্গণে পুরুষ ব্রাত্য...সিঁদুরের তার কোনও অধিকার নেই। স্পিভাকের ‘স্ট্রাটেজিক এসএনসিয়ালিজম’-এর তত্ত্ব ধরে সিঁদুর হয়ে উঠেছে নারীর স্ব-ক্ষমতায়নের এক অনবদ্য অস্ত্র।
কালের নিয়মে উত্তরবঙ্গেও আছড়ে পড়েছে এক নতুন নারীবাদের ঝড়। দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে, সিঁদুরখেলাকে কেন্দ্রে রেখে। অবিবাহিতা নারী, ‘সিঙ্গল মাদার’-রা, বারবনিতারা, বিধবারা, তৃতীয় লিঙ্গের-সবাই সিঁদুরখেলায় নিজেকে উজাড় করে দিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছেন যে নারীবাদে অন্তত উত্তরবঙ্গ-দক্ষিণবঙ্গের কোনও ভেদাভেদ নেই। পৌরুষের ক্ষমতা-জাহিরের অঙ্গ হিসেবে এতদিন যাকে দেখা হত, সেই লাল সিঁদুর সমাজের সব বেড়াজাল ভেঙে মিলিয়ে দিয়েছে রায়গঞ্জের বিধবাদের, ‘রূপান্তরকামী’ ডাকে সিঁটিয়ে, ঘরের কোণে লুকিয়ে থাকা বালুরঘাটের মানুষদের, ‘খারাপ মেয়ে’ ডাকে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া শিলিগুড়ির বারবনিতাদের। রায়গঞ্জের উকিলপাড়ায় এ বছর শুরু হওয়া সমস্ত মেয়ে-মহিলাদের-সিঁদুর-খেলার একটি উজ্জল, ব্যতিক্রমী রীতি সংস্কৃতির শহর বালুরঘাটে–পশ্চিমবঙ্গের ক্ষুদ্রতম জেলাগুলির মধ্যে একটা, দক্ষিণ দিনাজপুরেও ছড়িয়ে পড়তে সময় নেয়নি একটুকুও। লাল-সাদা বসন, সোনালি গয়না, আর লাল সিঁদুরে লেপা মুখমণ্ডলের প্রতিটি নারীতে যেন বিরাজমান হয়ে উঠেয়েছিলেন স্বয়ং দেবী দুর্গা। আত্রেয়ী নদীর ঘাটের পাড় থেকে মহানন্দার বাঁকে, তিস্তার পাশের কাশবনের ঝাড় থেকে জলঢাকার প্রান্তিক পূজামণ্ডপে–সমস্ত নারীরা এ বার উৎসাহ আর সাহস দেখিয়েছেন সিঁদুরে নিজেদের ক্ষমতা যাচাই করে নেবার। আর পুরুষেরা? দূর থেকে কেউ বিরক্তির, আর কেউ প্রশংসার চোখে তাকিয়ে দেখেছেন নারীবাদের এই নতুন রূপের। বোধহয় ‘সিক্সথ-জেনারেশন ফেমিনিজম’, আর কি!
আমাদের মা-কাকিমাদের সময় কি এই ‘ফেমিনিজম’ ছিল না? অবশ্যই ছিল। শুধু ছিল না তা চিনে নেওয়ার ইচ্ছে, ক্ষমতা, আর সাহস।
সামাজিক পরিবর্তনের দমকা হাওয়ায় মানুষের চিন্তা, বুদ্ধি, যুক্তিকেই ক্রমাগত আধুনিক করেছে। দরকারও ছিল। যুগ-পরিবর্তনে আজ সিঁদুরখেলা কেবল স্বামীর-মঙ্গল কামনার অঙ্গ নয়ই, নারীর ক্ষমতায়নের এক নিদর্শনও বটে। ২০১৮-এর দশমীতে মা যখন নিমজ্জিত হচ্ছেন কুলিকের জলে, আত্রেয়ীয়ের বুকে, সূর্যের শেষ আলোর আভায় রক্তিম, সিঁদুর-রঞ্জিত শয়ে শয়ে নারীমুখগুলি দেখেই তিনি কি পাননি এক গভীর শান্তি? প্রান্তিক এই উত্তরবঙ্গের শহরগুলিতে কে ছিল না সেই দলে? রায়গঞ্জের উকিলপাড়া থেকে বালুরঘাটের, পতিরামের, গঙ্গারামপুরের বিভিন্ন পাড়ার অবিবাহিত মেয়েরা, রূপান্তকামীরা, বিধবারা, আর বারবনিতারা। তাঁদের নিয়ে কেউ মস্করা করেনি এতটুকুও। বরং অবাক চোখে দেখেছে কি ভাবে দুর্গা মায়ের মৃন্ময়ী মূর্তি চিন্ময়ী হয়ে প্রকাশ পাচ্ছে এই উৎসব-ক্লান্ত কিন্তু সামাজিক-ভাবে উজ্জীবিত মুখগুলিতে। মানসিক বিষণ্ণতার পরিবর্তে স্থান পেয়েছে দৃঢ়তা।
এমন অনেক প্রথা রয়েছে যা সমাজের পক্ষে হিতকর তো নয়ই, বরং সেগুলো মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে। এগুলি মানুষে মানুষে ভেদভেদী–হানাহানি–হিংসার উদ্রেক ঘটায়, যা আমাদের, নারী-পুরুষদের, যৌথ ভাবে এগিয়ে এসে রদ করা একান্তই প্রয়োজন। ভাবি প্রজন্মকে সঠিক ভাবে শিক্ষিত করা ও সেই শিক্ষাকে সমাজের কল্যাণে বা গঠনমূলক কাজের যথাযথ ভাবে প্রয়োগ করাই যেন শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য হয়। নারী শাসিত এই রাজ্যের নারীর সম্মান, নারীর মর্যাদাকে সুরক্ষিত করার দায় আমাদের সকলেরই। যে হাত মাতৃরূপী, শক্তিময়ী, চিন্ময়ী মা দুর্গার পূজা করে, সেই হাতই যেন সর্বদা ঘরের দুর্গার বা লক্ষ্মীর সুরক্ষায় রত থাকে, এই আমাদের কাম্য।
(লেখক বালুরঘাট মহিলা মহাবিদ্যালয়ে ইংরেজির শিক্ষক।
মতামত নিজস্ব)