জীবন: বয়ে চলা মহানন্দা। শিলিগুড়িতে শনিবার।নিজস্ব চিত্র
শহরের মধ্যে দিয়ে যে নদীটি চলে গিয়েছে বারবার, যার উপরে রয়েছে পরের পর সেতু, তাকে কি নদী বলে মনে হত আগে? জলের রং কালো। পাড় ধরে নোংরা আর আবর্জনা। ওর নাম মহানন্দা।
ফুলবাড়ি ব্যারাজের নীচে বইত ঘোলাটে জল। মাছ কমে গিয়েছিল অনেক দিনই। আশপাশের শিমুল, শিরিষ গাছের মাথায় পাখি হয়তো বসত, কিন্তু তাদের ডাক শোনার কি জো ছিল! ওর নামও মহানন্দা।
গত তিন মাসে যাবতীয় দূষণ, নোংরা, আবর্জনা ঝেড়ে ফেলে নদী বদলে গিয়েছে। সেই টলটলে জল। পাখির শব্দ। এমনকি, শহরে ধনেশ পাখি আবার দেখতে পেয়েছেন পরিবেশপ্রেমীরা। ব্যারাজের কাছেও ছবিটা বড় মনোরম। তাই দৃশ্যে জাল ফেলে মাছ ধরতে মন চায় না সহদেব সরকারের।
ষাটোর্ধ্ব সহদেব একসময় ব্যারাজের কাছে মহানন্দায় মাছ ধরে রোজগার করতেন। তার পরে নদীতে মাছ কমে গেল। বাধ্য হয়ে পুকুর লিজ় নিলেন সহদেব। কিন্তু ইজারাদার এ বারে লিজ়ে কড়ি বাড়িয়ে দ্বিগুণ করেছেন, কুড়ি হাজার টাকা। তাতেই পিছিয়ে আসতে হয়েছে সহদেবকে। শেষে লকডাউন কিছুটা শিথিল হলে তাঁকে স্ত্রী ললিতা পরামর্শ দেন, একবার ব্যারাজের ধারে ঘুরে এসো না! মাছ পেতেও তো পার। কাঁধে জাল ফেলে চলে এলেন সহদেব। এসে দেখলেন, নদীর জল স্বচ্ছ, দেখা যাচ্ছে তলায় শ্যাওলা ধরা পাথরও। মাছের ঝাঁক ঘুরে যাচ্ছে মাঝেমাঝে। আশপাশে হীরালাল বা সুমতির মতো কেউ কেউ জাল ফেলে ধরেও ফেলছেন বরোলি, পুঁটি, ট্যাংরার মতো নদীয়ালি মাছ। নদীর কাছে যাদের পাচ্ছেন, তাঁদেরই বেচে দিচ্ছেন জলের দরে। তবু সহদেব জাল ফেলছেন না। তিনি ঘুরে ঘুরে দেখছেন নদীকে। পাড় ধরে হাঁটছেন ইচ্ছেমতো।
নদীর যে রূপ খুলেছে, সেটা মানছেন পরিবেশকর্মী তথা ন্যাফের অনিমেষ বসুও। তিনি জানান, গাড়ি ধোয়া জল মিশছে না নদীতে। তাই জল আগের থেকে স্বচ্ছ। মহানন্দা অভয়ারণ্য থেকে ধনেশ পাখির দল নদী লাগোয়া এলাকায় ঘুরছে। অনিমেষবাবু বলেন, ‘‘নদীর স্বাস্থ্য ৫০ শতাংশ ভাল হয়ে গিয়েছে।’’
‘‘এমন নদীতে কি জাল ফেলতে ইচ্ছে হয়, বলুন!’’ হাসতে হাসতে বলছেন সহদেব। ললিতা বলেন, ‘‘ইস, কী যে করে না!’’ কিন্তু জীবন বড় কঠিন। জাল না ফেললেই বা চলবে কি করে? পানকৌরি, বালিহাঁস, মাছরাঙাদের দু’চোখ ভরে দেখতে দেখতে সহদেব বলেন, ‘‘এই সুখী নদীই তো আমাদের জীবন।’’