ভাঙন কবলিত বীরনগরে পুজোর প্রস্তুতি। —নিজস্ব চিত্র।
নেহাতই গ্রামের দুর্গাপুজো। জমকালো আয়োজন কোনও কালেই হয় না। তাই বাজেট বরাবরই ৭০ হাজার টাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু যে সমস্ত মানুষদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে ওই যত সামান্য বাজেটেই প্রতিবার পুজো হত, এ বার সেই পরিবারগুলিই গঙ্গা ভাঙনে সর্বস্বান্ত হয়ে কেউ স্কুলে বা কেউ অন্যের বাড়িতে এখন আশ্রয় নিয়ে আছেন। সকাল হলে দু’মুঠো অন্নের যোগান কী ভাবে হবে, তা ভেবেই তাঁরা কূল পান না। এই পরিস্থিতিতে দশভুজার পুজো এবার গ্রামে করা হবে কি না, তা নিয়েই দোলাচল দেখা দিয়েছিল। কিন্তু ১৯০৫ সাল থেকে শুরু হওয়া পুজো তো আর আচমকা বন্ধ করা যায় না।
তাই শেষ পর্যন্ত বাজেট ২০ হাজার টাকায় নামিয়ে এনে এবার নমো নমো করে মৃন্ময়ীর পুজো হবে মালদহের গঙ্গা ভাঙন কবলিত বীরনগরের সরকারটোলা গ্রামে। শত কষ্টেও ভাঙন পীড়িতরাই এখানে মায়ের আরাধনায় ব্রতী। এ বারের পুজোর মধ্যে দিয়ে মায়ের কাছে তাঁদের একটাই আর্তি, গঙ্গার সর্বগ্রাসী থাবা আর যাতে গ্রামে না পড়ে।
কালিয়াচক ৩ ব্লকের বীরনগর ১ গ্রাম পঞ্চায়েতের সরকারটোলা গ্রামের পাশ দিয়েই বয়ে গিয়েছে গঙ্গা। এলাকায় চওড়া বাঁধ থাকায় গ্রামের বাসিন্দারা তো বটেই, এমনকী এই গ্রামেরই বাসিন্দা বিধায়ক স্বাধীন সরকারও কস্মিনকালে ভাবেননি যে, সেই বাঁধ ভেঙে গঙ্গা ধেয়ে এসে গোটা গ্রামকে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দেবে। কিন্তু এবার জুলাই মাসের ২৯ তারিখ রাতে বীরনগরের সেই মার্জিনাল বাঁধের প্রায় ৫০০ মিটার অংশ ভেঙে গঙ্গা ঢুকে পড়েছিল সরকারটোলা গ্রামে। গ্রাস করেছিল প্রায় ৭০টি বাড়ি। এ ছাড়া শতাধিক পরিবার আতঙ্কে ঘরবাড়ি ভেঙে নিয়েছিল। ফের ২২ দিনের মাথায় এই গ্রামেরই আরও ৫০টা বাড়ির অন্তর্জলী যাত্রা হয়েছে। সে বারও শতাধিক পরিবার আতঙ্কে বাড়ি ভেঙে নিয়েছেন। আর সেপ্টেম্বরের ১৭ তারিখ তৃতীয় বারের হানায় আরও ২০টি বাড়ি গঙ্গাগর্ভে গিয়েছে।
ওই ভাঙন দুর্গতরা সর্বস্ব হারিয়ে কেউ বীরনগর হাই স্কুলে ঠাঁই নিয়েছেন বা কেউ অন্যের বাড়িতে। খোদ বিধায়কেরও বাড়ি প্রথম ধাক্কাতেই তলিয়ে গিয়েছে এবং আর পাঁচ জনের মতো তিনিও এক বন্ধুর বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে রয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে এবার গ্রামের একমাত্র বীরনগর সরকারটোলা সর্বজনীন দুর্গোৎসব হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছিল। কিন্তু ভাঙন দুর্গত গ্রামবাসীরাই শেষ পর্যন্ত পুজো করার সিদ্ধান্ত নেন। এ বার পুজো কমিটির সম্পাদকও হয়েছেন ভাঙনে বাড়িঘর হারানো এক গ্রামবাসী প্রলয় সরকার। তিনি বলেন, ‘‘সরকারটোলার বেশির ভাগ মানুষই গরিব। চাঁদাও কম ওঠে। তাই প্রতি বছর ৭০ হাজার টাকার মধ্যেই বাজেট থাকে। কিন্তু এবার গঙ্গা ভাঙনে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়ে গেল যে, পুজো তো দূরের কথা পরিবার-পরিজন নিয়ে কে কোথায় মাথা গুঁজবে, সেটাই বড় হয়ে দেখা দিল। তবে শেষ পর্যন্ত শত কষ্টেও আমরা গ্রামের স্থায়ী মন্দিরে ১১১ তম দুর্গাপুজোয় ব্রতী হয়েছি। বাজেট টেনেটুনে ২০ হাজার করা হয়েছে। কিন্তু সেই টাকাও উঠবে কি না সন্দেহ।
পুজো কমিটির সদস্য দেবব্রত সরকার, ভীম মণ্ডল, দেবাশিস মণ্ডল, রাজকুমার মণ্ডলেরা তাই একসুরে বলেন, এ বার আমরা মায়ের কাছে একটিই আর্তি জানাবো যে, মা জগজ্জননী যেন গঙ্গার গ্রাস থেকে আমাদের গ্রামকে রক্ষা করে। একই আর্তি যেন গ্রামের সকলেরই।