বাড়ির পাশে ইটভাটা তৈরির প্রতিবাদ করায় সশস্ত্র হামলা চালিয়ে এক স্কুলপড়ুয়া-সহ তিনজনকে জখম করল দুষ্কৃতীরা। সোমবার রাতে ঘটনাটি ঘটেছে মালদহ জেলার বৈষ্ণবনগর থানার লক্ষ্মীপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের নতুনটোলা গ্রামে। গুরুতর জখম অবস্থায় জগদীশ মণ্ডল (৪৫) ও তাঁর দুই ছেলে ছোটন ও পঙ্কজ চিকিৎসাধীন রয়েছে মালদহ মেডিক্যাল কলেেজ। ছোটন দশম শ্রেণির, ও পঙ্কজ কলেজে প্রথম বর্ষের ছাত্র।
পুলিশ ও পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, জগদীশবাবুর বাড়ির পাশে একটি ফাঁকা জায়গায় ইটভাটা তৈরি করছিল এক ব্যক্তি। সোমবার জগদীশবাবুরা আপত্তি তুলে কাজ বন্ধ করে দেন। দুই পক্ষের মধ্যে বচসা শুরু হয়ে যায়। স্থানীয়দের হস্তক্ষেপে বিষয়টি মিটে যায়। কিন্তু রাতে সাত-আট জনের একটি দল বাড়িতে গিয়ে ছোটনকে হাঁসুয়ার কোপ মারে বলে অভিযোগ। তা দেখে জগদীশবাবু ও তাঁর আরেক ছেলে পঙ্কজ ছুটে গেলে তাঁদেরও দুষ্কৃতীরা হাঁসুয়া দিয়ে কোপাতে থাকে বলে অভিযোগ। পড়শিরা ছুটে গেলে অভিযুক্তরা পালিয়ে যায়। আহতদের আশঙ্কাজনক অবস্থায় স্থানীয় গ্রামীণ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকেরা মালদহ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়।
জগদীশবাবুর অভিযোগ, বাড়ির পাশে ইটভাটা থাকায় ছাই উড়ে আসে। বাড়িতে থাকে যায় না। তাঁদের দাবি, বারবার ইটভাটা করতে নিষেধ করলে কোন কর্ণপাত করেনি তারা। বৈষ্ণবনগর থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন তিনি। বৈষ্ণবনগর থানার আইসি অসীম গোপ বলেন, ‘‘অভিযুক্তেরা ফেরার রয়েছে। তাদের খোঁজে গ্রামে তল্লাশি চলছে।’’
এ ভাবে প্রায় রাতারাতি বেআইনি ইটভাটা গজিয়ে ওঠায় দূষণ ছড়ানোর সমস্যা নিয়ে ইতিমধ্যেই একটি মামলা চলছে জাতীয় পরিবেশ আদালতে। ২০০১ সালেই সুপ্রিম কোর্ট একটি মামলার প্রেক্ষিতে নির্দেশ দেয়, কৃষিজমি নষ্ট করে ইটভাটা তৈরি করা চলবে না। কিন্তু এরপরেও পূর্ব ভারতের নানা রাজ্যে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে কোনও অনুমোদন ছাড়াই যে ভাবে ভাটা গজিয়ে উঠছে, উর্বর মাটি তোলা হচ্ছে তাতে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, এই অভিযোগে গত বছর পরিবেশ আদালতের কাছে মামলা করেন চুঁচুড়ার এক আইনজীবী, জয়দীপ মুখোপাধ্যায়। জয়দীপবাবু জানান, ‘‘কেবল দক্ষিণবঙ্গে আনুমানিক ৫০০০ কাছাকাছি অবৈধ রয়েছে। সেখানে বৈধ ইটভাটা বড় জোর ৪৫০-৫০০। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের অনুমতি না নিয়েই এগুলি কাজ করছে। প্রায়ই উর্বর জমি কেটে নিচ্ছে। ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।’’
জয়দীপবাবুর আরও অভিযোগ, পরিবেশ নষ্ট করার সঙ্গে সঙ্গে এই ভাটাগুলিতে শ্রমিকদের সুরক্ষাও ব্যহত হয়। এখানে কাজ করেন অধিকাংশই অসংগঠিত শ্রমিক। তাঁদের কোনও নির্দিষ্ট মজুরি নেই। বহু মহিলা-শিশু শ্রমিক কাজ করে। মহিলাদের উপর যৌন নির্যাতনের হার খুব বেশি। ইটভাটার কাজে স্বাস্থ্যের নানা ঝুঁকি থাকলেও, শ্রমিকরা কোনও সুবিধেই পান না। মালদহের কালিয়াচকের ঘটনায় আবারও অবৈধ ভাটার সঙ্গে দুষ্কৃতীদের যোগ স্পষ্ট হল, মনে করেছেন অনেকে।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞ এক আইনজীবীর বক্তব্য, বিভিন্ন ধরনের শিল্পের ক্ষেত্রে নানা ধরনের নিয়ম রয়েছে। ইটভাটাকে ‘কমলা’ বলে নিদির্ষ্ট করা হয়েছে। অর্থাৎ, যে কোনও ইটভাটা করতে গেলেই ট্রেড লাইসেন্সের সঙ্গে পরিবেশ দূষণ পর্ষদের অনুমতিও নিতে হবে। কিন্তু অধিকাংশই সেই অনুমোদন ছাড়া কাজ করছে। খুব বড় ইটভাটায় অবশ্য দূষণ পর্ষদের অনুমোদন ছাড়াও দরকার কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রকের অনুমোদন। তবে ছোট ইটভাটায় তার প্রয়োজন হয় না।
ভুমি ও ভুমি সংস্কার দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করার জন্য বাংলা ইটভাটা তৈরি করা যায়। তবে মাটি কাটার জন্য রাজস্ব দিতে হয়। পেশাগত কারণে কেউ বাংলা ইটভাটা তৈরি করতে পারে না। তবে কালিয়াচক ৩ ব্লকে অধিকাংশ গ্রামে বাংলা ভাটা তৈরি করে ব্যবসা করছেন অনেকে বলে অভিযোগ। এ ছাড়া মালদহের ক্ষেত্রে বিশেষ নিয়ম, আমের সময় বাগানে কোনও ইটভাটা করা যাবে না। এমনকী, লোকালয় থেকে দুরে করতে হবে।
ব্লক প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, কালিয়াচক-৩ ব্লকে বেআইনি ভাবে বাংলা ইটভাটার রমরমা কারবার চলছে। মালদহ জেলা পরিষদের বন ও ভুমি কর্মাধ্যক্ষ কংগ্রেসের মিজানুর রহমান বলেন, ‘‘বাংলা ইটভাটার সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। বেআইনিভাবে যেখানে সেখানে ভাটা তৈরি করে কিছু মানুষ ব্যবসা করছেন। এই ব্লকে চিমনি ভাটা না থাকায় অবৈধ ভাটার সংখ্যাটা বাড়ছে।’’ তাঁর আন্দাজ, কালিয়াচক-৩ ব্লকে প্রায় ৫০টির উপর বেআইনি ভাটা রয়েছে। প্রশাসনকে জানানো সত্ত্বেও তারা কোন কাজ করছে না বলে তাঁর অভিযোগ।
কালিয়াচক-৩ ব্লকের জয়েন্ট বিডিও সুব্রত কুমার মন্ডল দায় এড়িয়ে গিয়ে বলেন, ‘‘ভাটা সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় ভুমি ও ভুমি সংস্কার দফতর দেখাশোনা করে। তাই এই বিষয়ে তারা বলতে পারবেন।’’ মালদহের জেলা ভুমি ও ভুমি সংস্কার দফতরের আধিকারিক সঞ্জীব চাকি বলেন, ‘‘বাংলা ইটভাটার চালানোর ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম রয়েছে। জেলার বিভিন্ন জায়গায় আমরা বেআইনি ইটভাটায় অভিযান চালাচ্ছি। বেআইনি ভাটা বন্ধে অভিযান আরও বাড়ানো হবে।’’