অচেনা: জলপাইগুড়ি টাউন স্টেশনে বাহারি ট্রেন।
এ যেন অচেনার আনন্দ। যে সব ট্রেনে চড়া তো দূরের কথা, লাইন দিয়ে ছুটে যেতেও দেখেনি ওরা কোনও দিনও। সেই সব কেতাদুরস্ত ট্রেনই এখন দাঁড়িয়ে রয়েছে দুয়ারে। দিনরাত সেই সব ট্রেন দেখতে স্টেশনে দৌড়ে দৌড়ে আসছে শহুরে অপু-দুর্গার দল। বেশির ভাগই স্টেশন লাগোয়া কলোনির বাসিন্দা। আধময়লা পোশাক। কারও হাতে-মুখে কালি। কেউ পড়ার সঙ্গে গ্যারেজে কাজ করে। কারও অভিভাবক দিনমজুর।
জলপাইগুড়ি টাউন স্টেশনের শেষ লাইনে দাঁড়িয়ে লাল-কমলা রঙের আস্ত বাতানুকুল ট্রেন। সারা গায়ে আলপনা আঁকা। সেই ট্রেন দেখার জন্য পড়া ফেলে ছুটে আসছে ছেলেমেয়েরা। ট্রেনের খবর পেয়ে কাজের ফাঁকে এসে একবার দেখে যাচ্ছেন বড়রাও। মাঝেমধ্যেই এখন জলপাইগুড়ি টাউন স্টেশনে নানান ট্রেন এসে দাঁড়াচ্ছে। কখনও রাজধানী এক্সপ্রেস, কখনও কাচ-ঝকঝকে ভিস্তাডোমের কোচ। সেই সব ট্রেন দেখতে স্টেশনে কৌতূহলী ভিড় বাড়ছে এতদিন অতি-সাধারণ প্যাসেঞ্জার ট্রেন দেখে আসা কলোনির বাসিন্দাদের।
রাজধানী এক্সপ্রেস, ভিস্তাডোম বা কর্মভূমি এক্সপ্রেসের মতো আধুনিক কেতাদুরস্ত রঙিন ট্রেন জলপাইগুড়ি টাউন স্টেশন হয়ে যাতায়াত করে না। যদিও সম্প্রতি স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম কলেবরে বৃদ্ধি পাওয়ায় এনজেপি-র চাপ কমাতে এই সব ট্রেনকে জলপাইগুড়িতে এনে রাখা হচ্ছে। তাতেই অদেখা দৃশ্য দু’চোখ ভরে দেখার সাধ মেটাচ্ছেন স্টেশনের আশপাশের কলোনির প্রান্তিক পরিবারের কচিকাঁচা, বয়স্করা।
জলপাইগুড়ি টাউন স্টেশনে দাঁড়িয়েছিল এনজেপি-অমৃতসর কর্মভূমি এক্সপ্রেস। কাচের জানলা আঁটা ট্রেনটির সারা শরীরে নকশা কাটা। সেই ট্রেনের দিকে অপলক তাকিয়ে ছিল পায়েল বর্মণ। শহরের কদমতলা বালিকা বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী পায়েল বলল, “এত সুন্দর ট্রেন আগে কখনও দেখিনি। আমাদের এখান দিয়ে এমন ট্রেন যায়ও না। ট্রেনটা দু’দিন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আগে এখানে বাংলাদেশের ট্রেনও দেখেছি।” প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে অবাক বিস্ময়ে তখন ট্রেন দেখছে ছেলেদের আরেকটি দল। পাশের বস্তি থেকে বয়স্করাও এসেছেন ট্রেন-সন্দর্শনে।
এ যেন শহরের পিচরাস্তা নয়, যেন সেই স্বপ্নের কাশবন! সত্যজিতের ‘পথের পাঁচালী’র কাশবনের বুক চিরে যেন ট্রেন দেখতে ছুটে আসছে উত্তরের অপু-দুর্গারা! অধরাকে দেখার আনন্দ, অচেনাকে চেনার আনন্দ উছলে পড়ছে মলিন মুখগুলোয়! ছবি: সন্দীপ পাল ও সংগৃহীত।