রাতভর বৃষ্টিতেই জলমগ্ন নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন চত্বর। —নিজস্ব চিত্র।
ভুটান-সিকিম ঘুরে এ দিন সকালে এনজেপি পৌঁছেছিলেন ব্রিটিশ পর্যটক মার্টিন। পর্যটন সংক্রান্ত একটি গবেষণার কাজে সম্প্রতি এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ঘুরছেন। দিল্লিগামী রাজধানী এক্সপ্রেসে দিল্লি রওনা হয়েছেন তিনি। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনের সামনে গাড়ি থেকে পা নামাতেই জমা জলে ভিজে গিয়েছে তাঁর কাপড়ের জুতো। প্ল্যাটফর্মে উঠে স্পিরিট দিয়ে কাঁদা লেগে যাওয়া পা পরিষ্কার করতে করতে বলেছেন, ‘‘ভাগিস্য, হাঁটু পর্যন্ত লম্বা প্যান্ট পড়া ছিল। প্যান্ট আর বেশি লম্বা হলে সেটিও ভিজে যেত।’’
দিন দুয়েক আগেই ট্রেনের কামরায় যাত্রীদের নানা ভাবে নাকাল হওয়ার অভিযোগ শুনতে হয়েছিল নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন কর্তৃপক্ষকে। শনিবার সকালে স্টেশনে ঢোকার রাস্তা থেকেই দুর্ভোগ শুরু হয়ে যায় যাত্রীদের। রাত থেকে ভোর পর্যন্ত বিক্ষিপ্ত বৃষ্টিতে স্টেশনে ঢোকার রাস্তায় জল জমে যায়। জলে থইথই করতে থাকে স্টেশনের প্রিপেড ট্যাক্সি বুথ। জল জমে যায় স্টেশনে ঢোকার মূল গেটে। গাড়ি করে স্টেশনে এসেও যাত্রীদের স্টেশন চত্বরে জমে থাকা নোংরা জলে পা ডোবাতে হয়েছে। স্টেশনের সামনে যেখানে গাড়ি থামিয়ে যাত্রী নামানো হয় সেখানে সকাল দশটা পর্যন্ত জল জমে ছিল।
তার আগেই আপ দার্জিলিং মেল, পদাতিক এক্সপ্রেস স্টেশনে পৌঁছেছে। এই দুই গুরুত্বপূর্ণ ট্রেনের একাধিক এক্সপ্রেস এবং প্যাসেঞ্চারের যাত্রীদের এনজেপি স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে নেমে, জমা জল ভেঙে মূল দরজা বাইরে বের হতে হয়েছে। সাধারণ যাত্রীদের মতোই দেশি-বিদেশি পর্যটকদেরও স্টেশনে নাকাল হতে হয়েছে বলে অভিযোগ। এই ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে ট্যুর অপারেটররাও। উত্তরবঙ্গের পাহাড়-ডুয়ার্স এবং সিকিমগামী পর্যটকদের সিংহভাগই এনজেপি স্টেশন হয়ে যাতায়াত করেন। উত্তরবঙ্গে পৌঁছেই তাঁদের নোংরা জমা জলে পা দিতে হওয়ায়, তাঁদের কাছে কী বার্তা পৌঁছল তা ভেবেই উদ্বেগে ট্যুর অপারেটরদের সংগঠনও। রেল কর্তৃপক্ষ অবশ্য জলবদ্ধতার কারণ হিসেবে জবরদখলকেই দায়ী করেছেন। স্টেশন চত্বর জুড়ে নিকাশির জন্য ভূগর্ভস্থ নর্দমা রয়েছে। সেই নর্দমায় জল ঢোকার জন্য তারজালি পাতা রয়েছে। কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, স্টেশন চত্বর জুড়ে সেই নর্দমার মুখের উপরে অবৈধ ভাবে দোকান গজিয়ে উঠেছে। কোথাও আবার নর্দমার মুখ জবরদখল করে তৈরি দোকানঘরের খুঁটিতে আটকা পড়েছে। সে কারণেই নর্দমা উপচে নোংরা জল গড়াচ্ছে স্টেশনে ঢোকার মুখে। বৃষ্টির পরে অন্তত ৩-৪ ঘণ্টা জল জমে থাকছে বলে অভিযোগ। বর্তমানে রেলের যাত্রী উপভোক্তা পক্ষ উদযাপন হচ্ছে। উত্তরপূর্ব সীমান্ত রেলের দাবি, খুব শিগগিরি স্টেশন চত্বর থেকে অবৈধ নির্মাণ সরিয়ে দেওয়া হবে।
উত্তরপূর্ব সীমান্ত রেলের সিনিয়র এরিয়া ম্যানেজার পার্থসারথী শীল বলেন, ‘‘গত কয়েক বছর ধরে স্টেশন চত্বরের জবরদখল সরাতে চাইছি। প্রতিবারই আইনশৃঙ্খলার সমস্যা হয়েছে। প্রশাসনের আরও বেশি সক্রিয় সহযোগিতা চাই। বেশ কয়েকবার চিঠিও দিয়েছি। ফের চিঠি দেওয়া হবে।’’ সরাসরি মন্তব্য করতে না চাইলেও, দার্জিলিং জেলা প্রশাসনের এক পদস্থ আধিকারিকের কথায়, ‘‘চিঠি পেলে, আলোচনা হবে।’’
এ দিন সকাল সাড়ে ৯টার সামনে স্টেশনের মূল গেটের সামনে জল জমে থাকতে দেখা গিয়েছে। বিদেশী পর্যটক মার্টিন সৌজন্য বজায় রেখে মন্তব্য করলেও, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামুলক সাহিত্যের ছাত্রী অন্বেষা দত্তের কথায়, ‘‘স্টেশনে নেমেই জল-কাদায় দাঁড়াতে হয়, এই কথা প্রচার হয়ে গেলে, পর্যটকরা মুখ ফিরিয়ে নেবে। পর্যটনের গালভরা বিজ্ঞাপন দেওয়ার পরিবর্তে, পরিকাঠামোর দিকে সরকার নজর দিক।’’
ঘটনাচক্রে এ দিন সকালে স্টেশনে এসেছিলেন ট্যুর অপারেটরদের সংগঠন এতোয়ার কার্যকরী সভাপতি সম্রাট সান্যাল। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘‘কেন্দ্র-রাজ্য দু’তরফেই যদি উত্তরবঙ্গের পর্যটনে যথাযথ গুরুত্ব না দেয়, তবে কোনও উদ্যোগেই লাভ নেই। এনজেপি স্টেশনে প্রতিদিনই অসংখ্য পর্যটক যাওয়া-আসা করেন। তাই এই স্টেশনের যাত্রী স্বাচ্ছন্দ্যে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া উচিত।’’ দুর্ভোগে পড়ে পর্যটকেরা মুখ ফেরালে শহরের অর্থনীতিও যে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তা জানেন শিলিগুড়ির মেয়র অশোক ভট্টাচার্যও। এ দিন তিনি বলেন, ‘‘এনজেপি স্টেশন চত্বরের পরিকাঠামো রেলের দায়িত্বে। তবে স্টেশনে এসে পর্যটকদের দুর্ভোগে পড়তে হলে, শিলিগুড়ি শহরের সম্মানও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ বিষয়ে দ্রুত রেলের সঙ্গে সমন্বয় বৈঠক করব। পুরসভার কিছু করার আছে কি না তাও দেখা হবে।’’