ফালাকাটার পথে কেন্দ্রীয় বাহিনীর টহল। মঙ্গলবার রাজকুমার মোদকের তোলা ছবি।
ভোটের দিন ঘোষণার আগে কেন্দ্রীয় বাহিনী পৌঁছলেও তা কোথায় মোতায়েন করা হচ্ছে, তা নিয়ে উত্তরবঙ্গের ৭ জেলার শাসক ও বিরোধী দলের মধ্যে চাপানউতোর শুরু হয়েছে। উভয় পক্ষই কেন্দ্রীয় বাহিনীকে ‘ঠিকঠাক জায়গায়’ মোতায়েন করা না হলে নির্বাচন কমিশনের কাছে লিখিত অভিযোগের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। বিরোধীদের তরফে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে, শাসক দলকে খুশি করতে বিরোধীরা যেখানে শক্তিশালী, সেখানেই বেশি বাহিনী মোতায়েন করেছেন প্রশাসনের একাংশ। আবার শাসক দলের একাধিক নেতার আশঙ্কা, পছন্দসই জায়গায় কেন্দ্রীয় বাহিনীকে টহলদারিতে নামানোর জন্য বর্তমান বিরোধী দল অতীতের যোগাযোগকে কাজে লাগিয়ে প্রশাসনের একাংশের কাছ থেকে তলে তলে মদত নিচ্ছেন।
ফলে, উত্তরবঙ্গের অনেক জেলা প্রশাসনই ফাঁপড়ে পড়েছে।
এই অবস্থায়, জেলা প্রশাসনের একাধিক কর্তা তাই রাজ্য নির্বাচন দফতরের মাধ্যমে কমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে বাহিনী মোতায়েনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। নির্বাচনের দায়িত্বপ্রাপ্ত একাধিক প্রশাসনিক অফিসার একান্তে জানাচ্ছেন, তাঁরা দু-তরফের ঠেলাঠেলিতে পিষ্ট হতে চান না বলেই মেপে পা ফেলছেন। উত্তরবঙ্গের বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী জেলার একজন অফিসার জানান, তাঁরা সামগ্রিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কথা জানিয়ে রাজ্য নির্বাচন দফতরের মাধ্যমে কমিশনকে রিপোর্ট দিচ্ছেন। পুলিশের পক্ষ থেকেও রাজ্য পুলিশের সদর দফতরের মাধ্যমে দৈনন্দিন গোলমাল, মামলা, গ্রেফতার ও বাজেয়াপ্ত সামগ্রীর পরিসংখ্যান যাচ্ছে কমিশনের কাছে। কমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেই কেন্দ্রীয় বাহিনী কোথায়, কতটা মোতায়েন হবে, তা ঠিক হয়েছে বলে জেলা প্রশাসনের একাধিক কর্তার দাবি।
কিন্তু, পাহাড় থেকে সমতল, বিরোধীদের মত অন্যরকম। তাঁদের অনেকেরই জানান, প্রথম দফায় উত্তরবঙ্গে যে ২৯ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী পৌঁছেছে, তাদের যে ভাবে নানা জেলায় পাঠানো হয়েছে তাতেই সন্দেহ জোরদার হচ্ছে। যেমন গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার একাধিক নেতা জানান, দার্জিলিং পাহাড়ে গত ৬ মাসে কোনও গুলি-বোমা চলেনি। খুনোখুনিও ঘটেনি। রাজনৈতিক সংঘর্ষও প্রায় নেই। তা সত্ত্বেও সেখানে প্রথম দফাতেই কেন ১০ কোম্পানি মোতায়েন করা হয়েছে, সেই প্রশ্ন তুলেছে মোর্চার অনেকেই। তবে পাহাড়ের বিরোধী দল জিএনএলএফ সহ অনেকেই পাল্টা যুক্তি দিয়েছেন, ভোটের অনেক আগে থেকে চোরাগোপ্তা হুমকি চলে বলেই কেন্দ্রীয় বাহিনীকে দ্রুত মোতায়েন করাটা যুক্তিযুক্ত হয়েছে।
পাহাড়ে মোর্চা বিরোধী দল যে যুক্তি দিচ্ছে, সমতলের উত্তর দিনাজপুরে সেটাই হাতিয়ার করছে রাজ্যের শাসক দলের একাংশ। সে জন্য সেখানে প্রথম পর্বেই ৫ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী পাঠিয়ে টহল দেওয়ানোর পক্ষে সওয়াল করেছেন তাঁরা। তাঁদের কয়েক জনের দাবি, উত্তর দিনাজপুরে ভোট পর্বের গোড়া থেকেই নানা কায়দায় এলাকায় আতঙ্ক ছড়ানোর চেষ্টা হয়ে থাকে। কেন্দ্রীয় বাহিনী সক্রিয় থাকলে সেটা তত সহজে হবে না বলেই মনে করেন শাসক দলের ওই নেতারা। যদিও এখনও কংগ্রেসের ‘দুর্গ’ হিসেবে পরিচিত উত্তর দিনাজপুরের কংগ্রেস নেতাদের কয়েকজনের পাল্টা আশঙ্কা, কেন্দ্রীয় বাহিনীকে কাজে লাগিয়ে আতঙ্ক ছড়ানোর চেষ্টা হতে পারে।
বস্তুত, বাহিনী মোতায়েন করা নিয়ে মালদহ, জলপাইগুড়ি ও আলিপুরদুয়ারে শাসক ও বিরোধীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ক্রমশ বাড়ছে। যেমন, বিরোধী দলের অনেকে গত বিধানসভা ভোটের কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরেছেন। সে বার বানারহাট, লঙ্কাপাড়া এলাকায় গোলমালের আশঙ্কা সত্ত্বেও জলপাইগুড়িতে কেন্দ্রীয় বাহিনীর একটা অংশকে ভক্তিনগর এলাকায় রাখা হয়। ভোটের দিন লঙ্কাপাড়া এলাকায় ইভিএম লুটের ঘটনা ঘটে। কেন্দ্রীয় বাহিনী ভক্তিনগর থেকে সেখানে পৌঁছনোর আগেই ভোট প্রক্রিয়া লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছিল।
আবার মালদহে কালিয়াচক সহ একাধিক এলাকায় বুথ-জ্যাম, হুমকি দেওয়া সহ নানা অভিযোগ ওঠে। সেই সময়ে কেন্দ্রীয় বাহিনী চাঁচলে থাকায় ঘটনাস্থলে পৌঁছতে বেলা গড়িয়ে যায়। তত ক্ষণে আতঙ্কে অনেক ভোটারই বাড়ি গিয়েছেন। মালদহ জেলা কংগ্রেসের নেতাদের কয়েকজন জানান, তাঁরা ইতিমধ্যেই সামগ্রিক পরিস্থিতি ঠিক কী, সেটা নির্বাচন কমিশনকে অবহিত করেছেন। কেন মালদহের মতো স্পর্শকাতর এলাকা, যেখানে গত ৬ মাসে দুবার কালিয়াচক থানায় হামলা হয়েছে, সেখানে বেশি সংখ্যক বাহিনী মোতায়েন করা হবে না সেই প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। রাজ্য পুলিশ-প্রশাসনের একাধিক কর্তা অবশ্য দাবি করেন, দ্বিতীয় দফায় সব মিলিয়ে ১০০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী পৌঁছবে। সে সময়ে স্পর্শকাতর সব এলাকায় বাহিনী পাঠানো সম্ভব হবে বলে তাঁদের ধারণা।