অসহায়: পান-বিড়ির দোকানে নিহত শ্রমিক সাকেরের বাবা। নিজস্ব চিত্র
ভোট এলে এক সময় গোটা বাড়ি গমগম করত। পরিবারের কর্তা গিয়াসুদ্দিন আহমেদ ছিলেন সক্রিয় সিপিএম কর্মী। গ্রামের মানুষ জড়ো হতেন উঠোনে। আর বাড়ির কর্তাও নাওয়া খাওয়া ভুলে তাঁদের সঙ্গে আড্ডায় মাততেন, ঘুরে বেড়াতেন এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত।
এ বারেও আর এক ভোট। কিন্তু চাঁচলের বিহার লাগোয়া মহানন্দা পাড়ের স্বরূপগঞ্জে গিয়ে দেখা গেল সেই বাড়ি খাঁ খাঁ করছে। ওই বাড়ির মতোই নিঝুম গোটা গ্রামই। গত বছর পরিবারটির উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝড়ের রেশ এখনও টাটকা পড়শিদের মনে। আট মাসের ব্যবধানে দু’-দু’টো ছেলের মৃত্যু, গ্রামের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাই যেন বদলে দিয়েছে।
গত বছর ১৬ জানুয়ারি রাজস্থানের জয়পুরের শাস্ত্রীনগরে শ্রমিকের কাজে গিয়ে খুন হন সাকের আলি। দাদার মৃত্যুর পরে সংসারের হাল ধরেন ভাই জাকির আলি। কিন্তু কলকাতা থেকে ফেরার পথে নভেম্বরে পথ দুর্ঘটনায় মারা যান জাকিরও। সেই সাকের আর জাকিরের বাবা গিয়াসুদ্দিনই সৎ এবং প্রতিবাদী রাজনৈতিক কর্মী বলে এককালে গ্রামের মানুষের আস্থার ভরকেন্দ্র ছিলেন।
পড়শিরাই জানালেন, ষাটোর্ধ্ব গিয়াসুদ্দিনের শরীর আর চলে না। বেশির ভাগ দিন বিছানায় শুয়ে কাটে। একটু সুস্থ হলেই বাঁধের উপরে টুল পেতে পান, বিড়ি, চকোলেট বেচেন। পেটটা তো চালাতে হবে। আর শোক ভুলতে গিয়াসুদ্দিনের স্ত্রী ওবেদা বিবি এক আত্মীয়ের বাড়ি থেকে আর এক বাড়িতে ঘুরে বেড়ান।
রাজস্থানে কালিয়াচকের আফরাজুলের হত্যাকাণ্ডের পরে সাকেরের খুন নিয়েও কম হইচই হয়নি। বাড়িতে হাজির হয়ে বহু প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তাবড় নেতারা। দিল্লি থেকে ছুটে এসেছিলেন মানবাধিকার সংগঠনের কর্মীরা।
রাজস্থানে ডেকোরেটর সংস্থায় শ্রমিকের কাজ করতেন সাকের। কিন্তু কী ভাবে তিনি খুন হয়েছিলেন তা আজও অজানা। সিবিআই তদন্ত চেয়ে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে গিয়েছিলেন ভাই জাকির। তৃণমূল নেতারাই তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলেন। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা হয়নি। তাঁর দফতরে চিঠি দিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু বছর গড়িয়েছে, রাজস্থানে সরকার বদলেছে। কিন্তু সিবিআই তদন্ত হয়নি। রাজস্থান সরকারের তরফে রহস্যের জট খুলেছে কি না তাও জানা যায়নি।
মহানন্দা বাঁধের উপরে দেখা মিলল বৃদ্ধ গিয়াসুদ্দিন আহমেদের। পরিচিত মুখ দেখে বৃদ্ধের চোখে জল। বললেন, ‘‘সাকের খুন হওয়ার পরে সরকারি সাহায্য মিলবে বলে জাকির তৃণমূলে নাম লিখিয়েছিল। নেতারা এসে আশ্বাস দিয়েছিলেন, বার্ধক্য ভাতার ব্যবস্থা করে দেবেন। সে তো হলই না। ছেলের খুনের বিচারও পেলাম না।’’
এখনও ওই গ্রামে কেউ ভোট প্রচারে যাননি। প্রতিবেশী কামাল হোসেন, হোসনেয়ারা বিবি বলেন, ‘‘এখানে এসে ভোট চাইবে, সেই মুখ কারও আছে নাকি। আর এলে বলব, কেন সাকেরের খুনের বিচার পেলাম না, কেন ওর বাবার বার্ধক্য ভাতা আজও হল না। আগে এ সব হোক, তার পরে ভোট।’’