দলীয় কার্যালয় খুলে চেয়ার-টেবিল সাজিয়ে বসেছিলেন তাঁরা। তবে, এক বেলা। পরের দিন থেকেই সেই নয়া কার্যালয়ে তালা ঝুলছে।
ঘটনাস্থল শিলিগুড়ি পুরসভার ৩৫ নম্বর ওয়ার্ড। দলের নাম বিজেপি।
ব্যস্ত শিলিগুড়ির উপকণ্ঠে পুরসভার সংযোজিত ওই এলাকায় পার্টি অফিস একটা খুলেছে বটে সিপিএম, তবে সেখানে দলীয় কর্মী থেকে পাড়াপড়শির পা তেমন পড়ছে না। অনেক খুঁজেও দেখা মিলছে না অন্য বিরোধী শক্তি কংগ্রেসের।
শিলিগুড়ি পুর নির্বাচনের আটচল্লিশ ঘণ্টা আগে শহর লাগোয়া ওই এলাকায় এটাই বাস্তব চেহারা। কেন?
চোখে-মুখে আতঙ্কের স্পষ্ট ছাপ নিয়ে বিজেপি কর্মীদের অভিযোগ, ‘সন্ত্রাসের’ জেরে কার্যালয় খুলেও শেষতক বন্ধই রাখতে হয়েছে তাঁদের। পালাবদলের আগে এলাকায় শেষ কথা ছিল বামেরা। এখন নিজেরা এলাকায় সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলে বুঝিয়ে দিচ্ছে, পিছু হটেছে তারাও। আর কংগ্রেসের দাবি, শাসক দলের চাপা সন্ত্রাসে এলাকার বাসিন্দারা সাধ থাকলেও দলীয় প্রার্থীর সঙ্গে ‘দুটো ভাল-মন্দ’ কথা বলার সাহস পাচ্ছেন না।
এ কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডে শিলিগুড়ি পুরসভার তামাম সংযোজিত এলাকার ছবিটাই ধরা পড়েছে বলে মনে করছেন বিরোধীরা।
শিলিগুড়ি এসে বুধবার বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু তাই আগাম জানিয়ে রাখছেন— শুধু শিলিগুড়ি নয়, সন্ত্রাসটা শাসক দল ছড়িয়ে দিয়েছে কোচবিহার, মাথাভাঙা, তুফানগঞ্জ সর্বত্রই। তবে নির্বাচনের দিন এর একটা পাল্টা জবাবের ইঙ্গিতও দিয়ে রাখছেন তিনি। বলছেন, ‘‘সরকার তাদের শক্তির পরিচয় দেওয়ার চেষ্টা করছে। মনে রাখবেন তারা যদি ভোট করাতে ‘অন্য পদ্ধতি’ নেয় তা হলে তা ব্যুমেরাং হয়ে ফিরবে।’’
পুলিশ-প্রশাসনের বিরুদ্ধেও তোপ দেগে বিমানবাবু জানিয়ে রাখছেন ‘নিরপেক্ষ’ ভাবে কাজ করছে না তারা। এমনকী তাঁর অভিযোগ, ‘‘নিবার্চন কমিশনও বিধি মেনে ব্যবস্থা নিচ্ছে না।’’
এই আবহে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব অবশ্য জানিয়ে রাখছেন, ‘‘যদি কোথাও সন্ত্রাসের অভিযোগ ওঠে আমি নিজে গিয়ে ব্যবস্থা নেব।’’ তাঁর দাবি, তৃণমূল সন্ত্রাসে বিশ্বাস করে না।
আর বিরোধীরা এককাট্টা হয়ে জানাচ্ছেন, শিলিগুড়ির সন্ত্রাস তো ব্যতিক্রম নয়। সন্ত্রাস পড়শি জেলা কোচবিহারেও পা ফেলেছে বলে তাঁদের অভিযোগ।
দিনহাটার বাম বিধায়ক উদয়ন গুহ আগেই জানিয়ে রেখেছেন, নির্বাচনের দিন তৃণমূল সন্ত্রাস করতে এলে তাঁর ‘শবদেহে’র উপর দিয়েই তা করতে হবে। এ দিন বিমানবাবুও সে কথা ফের মনে করিয়ে দিয়ে দলীয় কর্মীদের চাঙ্গা করার চেষ্টা করেছেন।
‘শাসকের’ সন্ত্রাস ‘ক্যামেরাবন্দি’ করার পাল্টা চাপ দিয়ে রেখেছেন বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতা সিদ্ধার্থনাথ সিংহ।
তবে, শিলিগুড়ি পুরসভার সংযোজিত এলাকাগুলিতে সন্ত্রাসের তির অনেক সময়ে ঘুরে গিয়েছে বিরোধী শক্তির দিকেও। সেই তালিকায় রয়েছে হারানো জমি পুনরুদ্ধারে মরিয়া বামেরাও।
কংগ্রেসের অভিযোগ, সংযোজিত এলাকা সূর্য সেন কলোনির বিভিন্ন ব্লক ইতিমধ্যেই দখল নিয়েছে একই সঙ্গে তৃণমূল এবং সিপিএম। কলোনির ‘ডি’ ব্লক বামেরাই ‘দখলে’ রেখেছে বলে অভিযোগ করছে তারা।
বুধবার ওই এলাকায় তার আঁচও মিলেছে কিছু। সিপিএমের একটি বুথ অফিসের সামনে গিয়ে ‘লোকজন কই’, প্রশ্ন তুলতে স্থানীয় সিপিএম নেতা তাঁর মোটরবাইক বাহিনীকে তলব করে দেখিয়েও দিলেন
তাঁদের ‘লোকবল’। জানিয়ে রাখলেন, ‘‘এক ইঞ্চি জমিও বিনা যুদ্ধে ছেড়ে দেওয়া হবে না।’’ তৃণমূলের এক স্থানীয় নেতার অভিযোগ, আতঙ্ক ছড়াতে সিপিএম ভোটার স্লিপ দিতেও পাড়ায় পাড়ায় ঘুরছে ওই বাইক বাহিনী নিয়ে। পাল্টা ছবিও ধরা পড়ল— বামেদের বুথ অফিসে ভিড় দেখেই টহল শুরু হল তৃণমূলের বাইক বাহিনীর।
তৃণমূলের অভিযোগ, সূর্য সেন কলোনির লাগোয়া মোরবাজারে ‘পেশি শক্তি’ দেখাচ্ছে বিজেপি। তারা বহিরাগত লোকজনও জড়ো করছে এলাকায়। অভিযোগ, ‘লোক’ আসছে ঝাড়খণ্ড, বিহার থেকে। ওই এলাকায় ইতিমধ্যেই তৃণমূল-বিজেপি হাতাহাতির খবরও রয়েছে। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, যেখানে যে দলের জোর বেশি এলাকার দখলদারি রয়েছে তাদেরই হাতে।
নবগ্রাম এলাকায় বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, তৃণমূল আগাম
জানিয়ে দিয়েছে ভোট ‘একান্তই’ দিতে হলে সকাল সকালই
দিতে হবে। এক বাসিন্দার কথায়, ‘‘তৃণমূলের ফতোয়া, দুপুরের পরে ভোট দেওয়া
যাবে না।’’
আবার অন্য একটি সংযোজিত এলাকায় বিরোধীরাও এমনই কিছু ‘নির্দেশ’ জারি করে গিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন লাগোয়া সেন্ট্রাল কলোনিতে টিম টিম করছে কংগ্রেসের প্রচার-গাড়ি। জনশূন্য বামেদের বুথ অফিস। অথচ হইহই করে
খাওয়া দাওয়া চলেছে তৃণমূলের বুথ অফিসে।
স্থানীয় এক কংগ্রেস কর্মী বলছেন, ‘‘ইচ্ছা থাকলেও অনেকেই ভয়ে আমাদের সঙ্গে প্রচারে নামতে পারছেন না।’’ কীসের ভয়?
অভিযোগ, কংগ্রেসের প্রচারে নজরদারি চালাচ্ছে শাসক দলের বাইক বাহিনী। হুমকি দেওয়া হচ্ছে, ভোটের পরে তাঁদের ‘দেখে নেওয়া’র।
৩১ নম্বর জাতীয় সড়কের দু’পাশের ৪২, ৪৩, ৪৫, ৪৬, ৪৭ ওয়ার্ড জুড়ে এমনই সন্ত্রাসের আবহে থমথম করছে।
বিভিন্ন সংযোজিত এলাকায় বাইক বাহিনীর এই দাপট এবং বহিরাগতের আনাগোনা ঠেকাতে বুধবার সকাল থেকেই তিনবাতি মোড় এলাকায় তল্লাশি শুরু করেছে পুলিশ। চলেছে নিরন্তর টহল।
এই অভিযোগ পাল্টা-অভিযোগের মধ্যেই এ দিন সকালে তৃণমূলের রোড-শো’তে দেখা গেল অভিনেত্রী মহিমা চৌধুরীকে। কিন্তু সেই পদযাত্রায় লোক নেই বলে গোঁসা হয়নি তো শাসক দলের? সংযোজিত এলাকার চায়ের দোকানের ভিড়ে এও এখন আলোচ্য।