সঙ্গীতার পরিবারের সঙ্গে কথা বলছেন লিগাল এইড ফোরামের কর্মীরা। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক।
ধানের ছড়ার দু’পাশে আঁকা লক্ষ্মীর পায়ের চিহ্ন একদিকে থেবড়ে গিয়েছে। শনিবার দুপুরে পা আঁকার সময়ে দরজায় কড়া নেড়েছিল পুলিশ। মেয়ের কোনও খবর এল বুঝি, উৎকন্ঠায় আলপনা ছেড়ে হাতের আঙ্গুল উঠে গিয়েছিল। দেবীর পদচিহ্ন কিছুটা বিপর্যস্ত হয়ে গিয়েছে। শিলিগুড়ির শান্তিনগরের কুণ্ডু বাড়ির আলপনার একদিক বস্তায় চাপা পড়েছে। দু’মাস ধরে বাড়ির মেয়ের খোঁজ নেই। এবারে পুজো করবেন না বলেই ঠিক করেছিলেন সঙ্গীতা কুণ্ডুর মা অঞ্জলিদেবী। কিন্তু মেয়ের ‘মঙ্গলে’র কথা ভেবেই শেষ পর্যন্ত পুজোর আয়োজন করেছিলেন। রবিবার দুপুরে অঞ্জলিদেবী আক্ষেপ করলেন, ‘‘একসময়ে বাড়ির উঠোন, সব ঘর জুড়ে আলপনা আঁকা হতো, সঙ্গীতাও আঁকত। এবার তো নিয়ম রক্ষায় আঁকা হয়েছে।’’
রবিবার দুপুরে বাড়িতে বসেই অঞ্জলিদেবীকে আইনি সাহায্য করতে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের প্রতিনিধিরাও গিয়েছিলেন বাড়িতে। বাড়ির একচিলতে উঠোনে রাখা লাল রঙের প্লাস্টিকের চেয়ারে সকাল থেকে ঠায় বসে থাকলেন অঞ্জলিদেবী। ছেলে শম্ভুবাবু বললেন, ‘‘মা তো দু’মাসে কত ঘণ্টা ঘুমিয়েছে তা হয়ত হিসেব করে বলে দেওয়া যাবে। এ ভাবে চললে তো মা-ও অসুস্থ হয়ে পড়বে। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলেই, মা ভাবে এই বুঝি বোন ফিরল।’’
রান্নাঘরের সঙ্গে লাগোয়া দু’টি পাশাপাশি ঘর। সামনে ছোট বারান্দা। বারান্দায় টাঙানো দড়িতে দলা পাকিয়ে একসঙ্গে ঝুলছে গামছা, শাড়ি, জামা। লক্ষ্মীপুজোর জন্য মাসদুয়েক পরে ঘর পরিষ্কার হয়েছে। অঞ্জলি দেবীর কথায়, ‘‘মহালয়া, পুজো কোথা দিয়ে চলে গেল টেরই পেলাম না। গত দু’মাস থানা আর বিভিন্ন জায়গায় মেয়ের খোঁজে চক্কর কেটেই চলে গেল। কত কী শুনতে হয়েছে। কখনও চুপচাপ সয়ে গিয়েছি, কখনও মুখে আঁচল চাপা দিয়ে বেরিয়ে এসেছি।’’
এ দিন দুপুরে শান্তিনগরের বাড়িতে গিয়েছিলেন দার্জিলিং জেলা লিগাল এড ফোরামের প্রতিনিধিরা। পরিবারকে আইনি সহায়তা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন তাঁরা। ফোরামের সম্পাদক অমিত সরকার বলেন, ‘‘পুলিশের আরও মানবিক হওয়া প্রয়োজন।’’
রবিবার দুপুরে, এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে ভেসে আসছে পেঁয়াজ রসুন ভাজার গন্ধ। অঞ্জলিদেবী নীচু স্বরে বললেন, ‘‘আমার রান্না ভালবাসত মেয়েটা।’’ শীর্ণ শরীরটাকেই টেনে ঘরের ভিতর ঢুকে গেলেন তিনি। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন আঁকা আল্পনার দিকে। এর পরেই মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ফুঁপিয়ে উঠলেন। বিড়বিড় করে উঠলেন, ‘‘মেয়েটা কোথায় কী ভাবে আছে কে জানে! কয়েকজন কেন ব্যাপারটা ধামাচাপা দিতে চাইছে বলেই ভীষণ ভয় হচ্ছে।’’