জলে ভেসেছে বাড়ি। আশ্রয়ের খোঁজে আলিপুরদুয়ারের সূর্যনগরে। শনিবার। ছবি: নারায়ণ দে
মালদহ
রাতভর টানা বৃষ্টি। আর তাতেই ভাসল মালদহের গ্রাম থেকে শহর। একেই বৃষ্টি তার ওপর গঙ্গা ভাঙনের জেরে বিপর্যস্ত জেলার কালিয়াচক ৩ ব্লকের পারদেওনাপুর-শোভাপুর পঞ্চায়েত ও মানিকচক ব্লকের ভূতনির হীরানন্দটোলা ও দক্ষিণ চণ্ডিপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের বিস্তীর্ণ এলাকা। এ দিন গঙ্গার জলস্তর ছিল ২৩.৮৫ মিটার। জল বাড়ছে ফুলহর ও মহানন্দারও। পার অনুপনগরে একটি কালী মন্দির নদীতে তলিয়ে গিয়েছে। ভাঙন প্রতিরোধে বালির বস্তা নদীর জলের তোড়ে সাফ হয়ে ভূতনির রাজকুমারটোলায় নদী একেবারেই বাঁধের কাছে চলে এসেছে।
গত ২৪ ঘন্টায় মালদহ জেলায় মোট বৃষ্টি হয়েছে ৮৪.২ মিলিমিটার। সব চেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে ইংরেজবাজার ব্লকে। ফলে ফের বেহাল নিকাশির ছবি ফুটে উঠলো ইংরেজবাজার ও পুরাতন মালদহ শহরে। বৃষ্টির জমা জলে চরম দুর্ভোগের মুখে পড়তে হচ্ছে দুই শহরের বাসিন্দাদের। তাঁদের অভিযোগ, হাইড্র্যান্ট গুলি নিয়মিত সংস্কার না হওয়ায় সামান্য বৃষ্টিতেই জল জমে কার্যত বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে দুই শহরে। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে শনিবার সকাল থেকেই নিকাশি নালা সংস্কারে হাত লাগিয়েছে দুই পুরসভা কর্তৃপক্ষ।
ইংরেজবাজারের মহিলা কলেজ রোড, বিনয় সরকার রোড, নেতাজি মোড়-সহ দেশবন্ধু চিত্ত রঞ্জন পুরবাজার, কার্নি মোড় মার্কেটে হাঁটু সমান জল জমে থাকায় বিপাকে পড়েন সাধারণ মানুষ। একই সঙ্গে বৃষ্টির জলে ভাসছে সর্বমঙ্গলা পল্লি, মালঞ্চ পল্লি, ঝলঝলিয়া, সুভাষ পল্লি। ইংরেজবাজারের মতো পুরাতন মালদহের পুর বাজার, বাচামারি, শরৎ চন্দ্র পুরবাজার, ফুটানি মোড় প্রভৃতি এলাকা জলমগ্ন হয়ে রয়েছে। শুখা মরসুমে নিকাশি নালা সংস্কারের জন্য পুর কর্তৃপক্ষের কাছে একাধিক বার দাবি জানানো হলেও কোন সুরাহা হয়নি বলে অভিযোগ বাসিন্দাদের।
আলিপুরদুয়ার
শহর থেকে গ্রাম। বন্যা পরিস্থিতি আলিপুরদুয়ার জুড়েই। শুক্রবার রাত থেকেই জল বাড়তে থাকে কালজানি, সঙ্কোশ, রায়ডাক, তোর্সা, ডিমা, বাসরা সহ ছোট বড় সমস্ত নদীর। গভীর রাতে জল ঢুকে যায় আলিপুরদুয়ার শহর সংলগ্ন বীরপাড়া এলাকায়। সারা রাত কালজানি ও ডিমা নদীর জল দেখে জেগে কাটিয়েছেন বাসিন্দারা। পরিস্থিতি নজরে রাখতে শুক্রবার সারা রাত কন্ট্রোল রুমে কাটিয়েছেন জেলাশাসক দেবীপ্রসাদ করণম-সহ জেলা আধিকারিকরা।
জয়ন্তীর জলে প্লাবিত হল শামুকতলার ছোট পুখুরিয়া গ্রাম। জলবন্দি চারশো বাসিন্দা শামুকতলার সিধু কানহু কলেজে আশ্রয় নিয়েছেন। সেখানে ত্রাণ শিবির খুলেছে ব্লক প্রশাসন। কুমারগ্রামের ময়নাবাড়িতে তুরতুরি ঝোরার ঘোকসাবাঁধ ভেঙ্গে দশলিয়া, বাবুধারা, নয়াবস্তি, ময়নাবাড়ি রোড লাইন প্লাবিত হওয়ার ফলে ওই এলাকার তিনশো বাসিন্দা তুরতুরি চা বাগান প্রাথমিক স্কুলে আশ্রয় নিয়েছেন। কুমারগ্রামের বারবিশা লাল স্কুল এলাকায় রায়ডাক নদীর বাঁধে ফাটল দেখা দেওয়ায় বাসিন্দারা আতঙ্কিত। দ্রুত ফাটল মেরামতের দাবি তুলেছেন তাঁরা।
শামুকতলা বাজার এলাকায় আবার সেচ দফতরের অপেক্ষায় না থেকে গ্রামবাসীরাই ঝাঁপিয়ে পড়লেন বাঁধের ফাটল মেরামতিতে। গ্রামবাসীদের তৎপরতায় বাঁধ মেরামত না হলে ধারসি নদীর বাঁধ ভেঙ্গে গোটা এলাকায় প্লাবিত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। গ্রামবাসীরা নিজেরাই বালির বস্তা দিয়ে ফাটল ভরাট করেন। যদিও পরে শামুকতলা গ্রাম পঞ্চায়েতের উদ্যোগে সেখানে আরও বালির বস্তা ফেলা হয়।
দু’দিন ধরে পাহাড় সমতলের বিরামহীন বৃষ্টিতে জলমগ্ন ফালাকাটা, ধূপগুড়ি ও মাদারিহাটের বহু এলাকা। ডুডুয়া, বিরকিটি নদীর জলোচ্ছ্বাসে ধূপগুড়ি ফালাকাটার মধ্যে জাতীয় সড়কে কোথাও হাঁটু জল। কোথাও কোমর জল। শুক্রবার রাত থেকে শনিবার দিনভর ওই সড়কে বন্ধ যানবাহন চলাচল। ধূপগুড়ির ভুটনিরঘাট এলাকায় সড়ক জলের নিচে। ফালাকাটা ব্লকের গুয়াবর নগর, দেওগাও গ্রাম পঞ্চায়েতের বেশ কিছু গ্রামের পাঁচশোর উপর বাড়ি জলমগ্ন।
কোচবিহার
কোথাও জলের তোড়ে ভেঙে গিয়েছে বাঁধ। কোথাও স্রোতে ভেসে গিয়েছেন মানুষ। জাতীয় সড়কের উপর দিয়ে বইছে নদী। লাগাতার বৃষ্টিতে শনিবার ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে কোচবিহারে। বাড়ি-ঘর ছেড়ে হাজার হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন বাঁধের উপরে। সরকারি কোনও কর্তার দেখা না মেলায় ক্ষোভ বাড়ছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রীকে ফোন করে যাবতীয় খোঁজখবর নেন। তবে কোচবিহারের জেলাশাসক কৌশিক সাহা জানান, ৫১৭টি ত্রাণশিবির খোলা হয়েছে। ৩৯৬ টি জায়গায় প্রশাসনের তরফে রান্না করা খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। গোটা জেলায় একাধিক এলাকায় স্পিডবোট নামিয়ে মানুষদের উদ্ধার করা হয়েছে।
গত তিন দিন ধরে লাগাতার বৃষ্টিতে বিভিন্ন নদীর জল বাড়তে শুরু করে। তোর্সার জলে ঘুঘুমারি, টাকাগছ, টাপুরহাট, পানিশালা, কালজানি নদীর জলে বলরামপুর, দেওচড়াই, কৃষ্ণপুর, মারুগঞ্জ থেকে শুরু করে রায়ডাক, মানসাঁই ধরলা নদীর জলেও আশেপাশের সমস্ত গ্রাম ডুবতে শুরু করে। শনিবার সকালে কলার ভেলায় নিরাপদ জায়গায় যাওয়ার সময় কালজানি নদীতে ভেসে যায় সরেয়ার পাড়ের বাসিন্দা প্রসেনজিৎ রায় (১৯)।
কোচবিহার শহর জুড়েও একই রকম জলছবি। শহরের ব্যস্ততম কেশব রোড থেকে স্টেশন রোড নদীর চেহারা নিয়েছে। সুনীতি রোড বাই লেন থেকে নতুন বাজার, কলাবাগান থেকে গাঁধীনগর শুধু জল আর জল। পরিস্থিতির জেরে কিছু এলাকায় বাসিন্দারা ত্রাণ শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন। কল ডুবে যাওয়ায় শুরু হয়েছে পানীয় জলের সংকটও।শহরের রক্ষাকবচ বলে পরিচিত তোর্সার বাঁধ নিয়েও উদ্বেগ বেড়েছে। হাজরাপাড়া এলাকায় তোর্সার স্লুইস গেট চুঁইয়ে জল ঢুকতে শুরু করে। বাসিন্দারা বালির বস্তা দিয়ে তা আটকাতে নামার পর সেচ দফতরের কর্মীরা আসেন। প্রশাসনের এক কর্তা অবশ্য বলেন, ‘‘পরিস্থিতির দিকে নজর রাখা হয়েছে। উদ্বেগের ব্যাপার নেই।’’
শিলিগুড়ি
টানা বৃষ্টিতে মহানন্দার জল বেড়ে নদী লাগোয়া শিলিগুড়ি পুরসভার ওয়ার্ডগুলোর একাংশে ঢুকে পড়ে। সেবক রোডে একটি বড় গাছ ভেঙে পড়ে শনিবার ভোর থেকে দীর্ঘক্ষণ রাস্তা আটকে থাকে। দুপুরের পর গাছটিকে কেটে সরায় পুরকর্মীরা। মহানন্দার জল বেড়ে যাওয়ায় সকালে ফুলবাড়ি ব্যারাজ দিয়ে প্রতি সেকেন্ডে ১৩৫০ কিউমেক করে জল ছাড়তে হয়। বেলা ২টা নাগাদ তা ১১০০ কিউমেকে দাঁড়ায়। নদী লাগোয়া পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের রানিসতী মন্দিররোড, গঙ্গানগর, নতুন পাড়া এলাকায় ভোররাতে নদীর জল অনেক বাড়িতে ঢুকে পড়ে। ওই ওয়ার্ডে সন্তোষীনগরে ২ নম্বর ছট ঘাটের কাছে একটি বৈদ্যুতিক স্তম্ভ পড়ে যায়। খবর পেয়ে স্তম্ভের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন পুর কর্মীরা। পর্যটনমন্ত্রী গৌতম দেব বলেন, ‘‘উত্তরবঙ্গের জেলাশাসকদের সঙ্গে কথা বলেছি। রবিবার শিলিগুড়ির মৈনাক ট্যুরিস্ট লজে উত্তরবঙ্গের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠক ডেকেছি।’’ বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে পরিস্থিতি খতিয়ে দেখেন বিরোধী দলনেতা রঞ্জন সরকার। পরিস্থিতি দেখতে মেয়র পারিষদ মুকুল সেনগুপ্তকে নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় যান মেয়র অশোক ভট্টাচার্য। এ দিন ভোরের দিকে শক্তিগড় এলাকায় অশোকনগরে জলে ডুবে যায় রাস্তা। সেবকরোড, অশোকনগর, সূর্যসেন পার্ক লাগোয়া এলাকা ঘুরে দেখেন মেয়র। সূর্যসেন পার্কের কাছে রাস্তার ধারে, বাঘা যতীন পার্ক লাগোয়া সুভাষপল্লি এলাকাতেও গাছ ভেঙে পড়েছিল। সেগুলো পুর কর্মীরা সরান।
মেয়র বলেন, ‘‘ভোরের দিকে নদী লাগোয়া কয়েকটি জায়গা জলমগ্ন হয়ে পড়েছিল। তবে বেলা বাড়তেই জল নেমে গিয়েছে।’’ তিনি জানান, মহানন্দায় জল বেড়েছে। মহানন্দা ব্যারেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে পুর আধিকারিকরা যোগাযোগ রাখছেন বলে জানান তিনি। জেসিবি, ৩টি পাম্প, বালির বস্তা পর্যাপ্ত পরিমাণে মজুত করা রয়েছে। ১, ৩৬, ৪০ নম্বরের মতো বেশ কিছু ওয়ার্ড থেকে শুকনো খাবার চেয়ে পাঠানো হয়েছে।
১ নম্বর ওয়ার্ডের সাউথ অম্বেডকর কলোনি, ঠক্কর কলোনি এলাকা জলবন্দি। কাউন্সিলর মালতি রায় বলেন, ‘‘ওই জায়গাগুলো নীচু বলে জল জমেছে। তবে জল বার করার ব্যবস্থা হয়েছে।’’ ৫ নম্বর ওয়ার্ডে রানিসতী মন্দির এলাকায় অনেকের বাড়িতে জল ঢুকলেও বেলা ৯ টা নাগাদ জল নেমে যায়। ৪০, ৪১, ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের একাংশে, ৪৬ নম্বর ওয়ার্ডে রাজীবনগর, শিবাজিনগর এলাকায় জল জমেছে।
জলপাইগুড়ি
প্রবল বৃষ্টিতে ভাসল জলপাইগুড়ি শহরও৷ বহু মানুষ বাড়ি ছেড়ে উঁচু জায়গায় আশ্রয় নিয়েছেন৷ অনেককে বাড়ি থেকে উদ্ধার করে অন্যত্র নিয়ে যেতে হয়েছে৷ বাসিন্দাদের মতে, এত বৃষ্টি গত কয়েক বছর জলপাইগুড়িতে দেখা যায়নি৷ বিভিন্ন জায়গায় ত্রাণ নিয়ে অভিযোগ উঠলেও, তা উড়িয়ে দিয়েছেন পুরসভার কর্তারা। প্রশাসন সূত্রের খবর, এ দিন সকাল পর্যন্ত জলপাইগুড়িতে বৃষ্টি হয়েছে ২৯৫.২০মিলিমিটার৷ পুরসভা সূত্রের খবর, শুক্রবার রাত থেকে শহর জুড়ে হওয়া প্রবল বৃষ্টিতে তিন হাজার পরিবার জলবন্দি হয়ে পড়েছেন৷ কয়েকটি পরিবারকে উদ্ধার করতে দমকল বাহিনীকে নামাতে হয়৷ কংগ্রেস পাড়া, মহামায়া পাড়া, পান্ডাপাড়া, নেতাজি পাড়া, পরেশ মিত্র কলোনি, মোহন্ত পাড়া-সহ বিভিন্ন এলাকায় বাড়িতে জল ঢুকে যায়৷ কংগ্রেস পাড়ার অনেকেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে জলপাইগুড়ি-হলদিবাড়ি সড়কের উপর মাথায় ছাতা নিয়ে রাত কাটান৷ রাতেই জলপাইগুড়ি জেলা হাসপাতালের আউটডোরে জল ঢুকে যায়৷ সকালেও জল জমে থাকায় সমস্যায় পড়েন রোগীরা৷ এদিকে, সকালের দিক থেকে বৃষ্টির পরিমাণ খানিকটা কমলেও, অবস্থার বিশেষ উন্নতি হয়নি। পরেশমিত্র কলোনির নিজমাঠ এলাকার প্রচুর মানুষ রাস্তার উপরে আশ্রয় নিয়েছেন৷ অভিযোগ উঠেছে ত্রাণ নিয়ে৷ সিপিএম কাউন্সিলর প্রমোদ মণ্ডল বলেন, ‘‘সকালেই পুরসভার তরফে সবাইকে শুকনো খাবার দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল৷ কিন্তু দুপুর পর্যন্ত তা পাইনি৷’’ নিকাশি নিয়ে অভিযোগ করেছেন কংগ্রেস কাউন্সিলার পিনাকী সেনগুপ্ত। যদিও পুরসভার চেয়ারম্যানু মোহন বসু বলেন, ‘‘শহরে শুক্রবার রাত থেকে যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে তা গত দশ বছরে হয়নি৷ এর জন্যই জল জমেছে৷’’ পর্যাপ্ত ত্রাণের ব্যবস্থাও করা হয়েছে বলে জানান তিনি।