Uttar Dinajpur

গ্রামে ‘তালিবানি শাসন’! একঘরে করা পরিবারের সঙ্গে মিশলেই জরিমানা, জুটবে চড়, থাপ্পড়

ঘটনাটি উত্তর দিনাজপুর জেলার প্রশাসনিক ভবন থেকে মাত্র ৩ কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ সুশিহার গ্রামের। ২০-২৫ বছর ধরে নাকি সেখানে চলে আসছে এই ‘তালিবানি শাসন’।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

উত্তর দিনাজপুর শেষ আপডেট: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১১:২৫
Share:

প্রায় ৩ বছর ধরে একঘরে হয়ে রয়েছে জয়কান্ত বিশ্বাসের পরিবার৷ তাঁদের সঙ্গে কথা বলেন না গ্রামবাসীরা। নিজস্ব চিত্র।

প্রায় ৩ বছর ধরে একঘরে এক পরিবার। তাঁদের সোনার দোকানেও আসেন না পড়শিরা। আসলে ওই পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মিশলেই মাতব্বরদের নিদানে দিতে হবে আর্থিক জরিমানা। তার সঙ্গে জুটবে চড়, থাপ্পর এবং কান ধরে ওঠাবসার মতো সাজা। প্রায় ২০-২৫ বছর ধরে নাকি চলে আসছে এই ‘তালিবানি শাসন’। ঘটনাটি উত্তর দিনাজপুর জেলার প্রশাসনিক ভবন থেকে মাত্র ৩ কিলোমিটার দূরে কমলাবাড়ি ২ গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার দক্ষিণ সুশিহার গ্রামের। এই গ্রামে প্রায় ৩ বছর ধরে একঘরে হয়ে রয়েছে জয়কান্ত বিশ্বাসের পরিবার৷ তাঁদের সঙ্গে কথা বলেন না ওই এলাকার স্থানীয় বাসিন্দাদের কেউ। মুরুব্বিদের ভয়ে জয়কান্ত বাবুর পুত্র সুশান্ত বিশ্বাসের সোনার দোকানেও যান না গ্রামবাসীরা৷

Advertisement

মাস দুয়েক আগে গ্রামে তাস খেলার আড্ডায় হঠাৎ চলে যান জয়কান্ত। তাস খেলা চলাকালীন গ্রামের দুই যুবক জয়কান্ত বিশ্বাসের কথার উত্তর দেন। এই খবর গ্রামের মুরুব্বিদের কানে পৌঁছতেই ওই যুবকদের ডাকা হয় গ্রামের বারোয়ারি মন্দিরের মাঠে। একঘরে থাকা জয়কান্তের সঙ্গে কথা বলার অপরাধে গ্রামের দুই যুবকের কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করেন মুরুব্বিরা।

ওই পরিবারকে একঘরে করা হয় কারণ, জয়কান্ত বিশ্বাসের ছেলে সুশান্তের বিয়ের পর থেকে স্ত্রীর সঙ্গে বনিবনা হচ্ছিল না। সুশান্ত তাঁর শ্বশুরবাড়ির লোকেদের ডেকে মীমাংসার মধ্যে দিয়ে স্ত্রীকে বাপের বাড়ি নিয়ে যেতে বলেন বলে দাবি। এই ঘটনা মানতে চাননি গ্রামের মুরুব্বিরা। তাই তাঁকে নিদান দেওয়া হয় যে, সমাজে থাকতে গেলে স্ত্রীকে নিয়েই থাকতে হবে। না হলে পরিবার-সহ একঘরে হতে হবে। এমনকি, তাঁদের সঙ্গে কেউ কথা বললে তাঁদেরও জরিমানা দিতে হবে বলে জানিয়ে দেওয়া হয়। মুরুব্বিদের বিরুদ্ধে এমনই অভিযোগ সুশান্তের।

Advertisement

এলাকায় মুরুব্বিদের দাপট এতটাই যে, তাঁদের নিদানের কথা বাইরে প্রকাশ করতেও ভয় পান গ্রামবাসীরা। গ্রামবাসীদের দাবি, এই বিষয়ে সব কিছু জানেন স্থানীয় বিজেপি নেতা তথা গ্রাম পঞ্চায়েত সদস্য নারায়ণ চন্দ্র বালো। অভিযোগ, মাতব্বরদের ‘শাসনের’ সভায় মাঝে মধ্যে তাঁকেও দেখা যায়। তবে তিনি বিচারসভায় উপস্থিত থাকার কথা মেনে না নিলেও, গ্রামে যে মুরুব্বিদের শাসন চলে সে কথা স্বীকার করেছেন।

জয়কান্তের সঙ্গে কথা বলার অপরাধে ‘দোষী’ প্রশান্ত সরকার মুরুব্বিদের জরিমানার পরিমাণ কমানোর অনুরোধ করতেই তাঁকে সেই মুহূর্তে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে কান ধরে ওঠবস করানো হয়। দিন হাজিরায় শ্রমিকের পেশায় থাকা প্রশান্ত অনেক কষ্টে জরিমানার টাকা দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন। কিন্তু এই প্রসঙ্গে আর কিছু বলেননি তিনি। প্রশান্তের ওপর মুরুব্বিদের ‘তালিবানি শাসন’ দেখে আর এক ‘দোষী’ যুবক সমর বিশ্বাস গ্রামের মুরুব্বিদের ফতোয়া মেনে নেন। সংবাদমাধ্যমের গোপন ক্যামেরায় ধরা পড়েছে গ্রামের মুরুব্বিদের বক্তব্য। তাঁদের মন্তব্য, ওই গ্রামে পুলিশের কোনও প্রয়োজন নেই। প্রথমে সব কথা স্বীকার করলেও বিপদ বুঝতেই উত্তর দেওয়ার সময় এড়িয়ে যেতে থাকেন তাঁরা। তবে, গোপন ক্যামেরায় পরিষ্কার ধরা পড়েছে মুরুব্বি হরিপদ তরফদারের আস্ফালন। হরিপদ জানান, তাঁদের এলাকায় পুলিশের কোনও দরকার নেই। জরিমানা হিসাবে যে টাকা নেওয়া হয়, তা বারোয়ারি মন্দিরের পুজোর কাজে লাগানো হয় বলে জানান তিনি।

গ্রামবাসীরা কেউ ভয়ে প্রশাসনের দ্বারস্থ হন না। তবে সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের কাছে সবটা শুনে রায়গঞ্জের মহকুমা শাসক কিংশুক প্রামাণিক আশ্বাস দিয়েছেন যে, অভিযোগ পেলে তাদের তরফে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এলাকায় কোনও রকম খাপ পঞ্চায়েত যেন বসানো না হয়, তা নিয়ে ব্যবস্থা নিতে এলাকায় পুলিশ পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement