পুজো: জলপাইগুড়িতে ভ্রামরী দেবীর মন্দিরে চলছে পুজোর প্রস্তুতি। ছবি: সন্দীপ পাল
পঞ্জিকা মতে তখনও চর্তুদশী। পাঁচ রকম ফল, মিষ্টি, একশো আটটি প্রদীপ সব সাজানো। অমাবস্যা পড়লেই পুজো শুরু হবে। পুরোহিতের কিছু মনে পড়ল, আরতি থামিয়ে ব্যস্ত হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে জানতে চাইলেন, “এসেছে নাকি?” ভোরের পাখি দু’একবার ডেকেছে। মন্দিরে তখন দেবীকে প্রদীপ দেখানো হচ্ছে। প্রদীপ রাখা থালা হাতেই পুরোহিতের ফের প্রশ্ন, “এল নাকি?”
পুজো শেষ হল ভোরে। তখনও মন্দির ভরা ভক্তে। খিচুড়ি প্রসাদ বিলি হবে। জটাধারী পুরোহিত বেরিয়ে এসে বললেন, “যাক! আসেনি তা হলে!” কিন্তু কে আসবে? এই প্রশ্ন যদি সেই ভিড়ে দাঁড়িয়ে করে ফেলেন, তা হলে সকলে অবাক বিস্ময়ে ঘুরে তাকাবে আপনার দিকে। জলপাইগুড়ির বোদাগঞ্জের ভ্রামরী দেবীর মন্দিরে কালীপুজো হয় হাতি আসার আশঙ্কা মাথায় নিয়েই। এ বছর, প্রতি বছর।
এ মন্দিরে পঞ্চপ্রদীপ এবং সার্চলাইট দুইয়ের সহাবস্থান। বৈকুন্ঠপুরের জঙ্গলের মাঝে ভ্রামরী দেবীর মন্দির। মন্দিরকে অনেকটা সাপের মতো পেঁচিয়ে বয়ে চলেছে তিস্তা নদী। ৫১টি শক্তি পীঠের সব ক’টির পরিচয় যথাযথ ভাবে থাকলেও জলপাইগুড়ির ত্রিস্রোতা পীঠের নিখুঁত অবস্থানগত বর্ণনা পাওয়া যায় না। একাংশের দাবি, ত্রিস্রোতা নদীর ধারে শালবাড়িতে ভ্রামরী দেবীর মন্দির একান্ন পীঠের অন্যতম। বিশ্বাস, এখানে দেবীর বাঁ পা পড়েছিল।
সপ্তাহখানেক আগেই ৭৫টি হাতির দল মন্দির চত্বরে এসে দাঁড়িয়েছিল, জানালেন বাসিন্দারা। গত সোমবার রাতেও মন্দিরের পিছনে হাতির দল এসে গাছ মুড়িয়ে গিয়েছে। এ বছর অমাবস্যা তিথি দেরিতে শুরু বলে পুজো সারতে রাত গড়িয়ে যাওয়ার কথা। আর তাতেই দুশ্চিন্তা বেড়েছিল সকলেরই।
জঙ্গল পথ দিয়ে এগোতে হয় মন্দিরে। দরজায় আলো থাকলেও মন্দিরে ঢোকার রাস্তা অন্ধকার। শাল গাছের ফাঁক দিয়ে আঁকাবাঁকা পথ। পুরোটা গাড়ি যায় না। গাড়ি থেকে নামতে নাকে এল ধূপধুনোর গন্ধ। কিছুটা এগোতে স্পষ্ট হল কাঁসর-ঘণ্টা। জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি থেকে এসেছেন ভক্তরা। কেউ পুজো দেখছেন, কেউ পুজো দিচ্ছেন। কেউ এনেছেন লাল বেনারসি, কেউ ফল। শিবের ওপরে থাকলেও দেবীর জিভ বের করা নেই, সিংহবাহিনী ভ্রামরী দেবী একই সঙ্গে দুর্গা, আদ্যাশক্তি ও কামাখ্যা তিন মূর্তির মিশেল।
শক্তি পীঠ হলেও এ মন্দিরে বলি নিষেধ। পুরোহিত জটাধারী এক বৃদ্ধ। লোকমুখে প্রচলিত নাম মহাকাল ভৈরব বা লালবাবা। অন্ন ভোগ হলেও মাছ দেওয়া হয় না, কাটা ফলও নয়। শক্তিপীঠে বলি না হওয়ার কারণ? লালবাবার উত্তর, “পরপর তিন বার বলির পাঠা হারিয়ে যায়। বুঝলাম মা বলি চান না। তারপর থেকেই বন্ধ।”
দীপান্বিতা কালীপুজো শুরু হল সম্পূর্ণ অন্য মন্ত্রে। যা লালবাবার নিজের তৈরি। তাতেই অঞ্জলি দিলেন ভক্তরা। দেবী মূর্তিকে প্রণামের পরে লালবাবাকেও পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেন ভক্তরা। শ্যামাপুজোর শেষে তখন দেবী ভ্রামরীর নিত্য পুজোর আয়োজন শুরু করেছেন কালো বসন পরা জটাজুটো বৃদ্ধ পুরোহিত।