নদীতেই: ধানচাষ শিলিগুড়ির সাহু নদীর খাতে। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক
কংগ্রেস অফিসে বলে দলের এক প্রবীণ নেতা বলছিলেন, শিলিগুড়িতে চর দখলের জাল কী ভাবে গ্রাস করছে একে একে বালাসন, চামটা, পঞ্চনই, সাহু বা মহানন্দাকে (সেই চক্রের ছবি পাশে দেওয়া হল)। এই কাজে বড় অঙ্কের টাকা দফায় দফায় লগ্নি করেন এককালে সিপিএমের পছন্দের, এখন বর্তমান শাসক ঘনিষ্ঠ এক ব্যবসায়ী।
প্রশ্ন উঠেছে, কিন্তু শেষে যদি ব্যাঙ্ক ঋণখেলাপি হওয়ার জন্য জমি নিয়ে নেয়, তা হলে ব্যবসায়ীর লাভ কী? জবাবে ওই প্রৌঢ় নেতা হাসেন। তাঁর দাবি, ‘‘নিজে কেনার পরে তো সরকারি নথিতে ওই জমির দাম বাড়িয়ে দেখান ব্যবসায়ী। ধরুন ২০ কোটি। তা দেখিয়ে ১৫ কোটি টাকা ঋণ নেন। এর পরে ঋণখেলাপি হয়ে মোটা টাকা লাভ হয় তাঁর।’’
এ সব তথ্য-অভিযোগ রয়েছে দার্জিলিং জেলা কংগ্রেস (সমতল) সভাপতি শঙ্কর মালাকারের কাছেও। তিনি বলেছেন, ‘‘শিলিগুড়ির ১৬টা নদীর দখল করে কয়েক জন কোটিপতি হয়েছে, ফুলেফেঁপে উঠেছে এক শ্রেণির দালাল। যখন যে দল রাজ্যে ক্ষমতায় থাকে, এরা তখন তাদের সঙ্গে থাকে।’’ তাঁর বক্তব্য, ‘‘পুলিশ-প্রশাসন যদি কঠোর না হয়, এক দিন সকালে উঠে দেখা যাবে ওই দুষ্টচক্র চামটা নদী গিলে নিয়েছে। কোনও দিন দেখা যাবে পঞ্চনই আর নেই। বা লচকা বুজিয়ে দিয়েছে।’’
শিলিগুড়ির সব নেতাই নদী দখল চক্র নিয়ে ওয়াকিবহাল। খোদ পর্যটন মন্ত্রী গৌতম দেবও একাধিকবার দালাল চক্র ভাঙার চেষ্টা করেছেন। তিনি উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী থাকাকালীন মাটিগাড়ায় বিস্তীর্ণ এলাকার জমি দখলমুক্ত করা হয়েছিল। পরে সেই জমি হাতবদল হয়ে গিয়েছে। প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্যের আমলেও মহানন্দা, সাহু, জোড়াপানি, ফুলেশ্বরী দখলের চেষ্টা রোধের চেষ্টা হয়েছে। কাজের কাজ হয়নি। সম্প্রতি পর্যটনমন্ত্রী ফের দলীয় বৈঠকে জমির দালালির সঙ্গে কেউ যুক্ত থাকলে, দল থেকে বার করে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। অশোকবাবুও মনে করেন, জমি দখলে মদতকারীদের চিহ্নিত করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
এই ব্যাপারে সরব বিজেপিও। দার্জিলিং জেলা কমিটির যুব নেতা অভিজিৎ রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘যে কয়েক জন ব্যবসায়ী জমির কারবার করে ফুলেফেঁপে উঠেছেন, তাঁরা কোন কোন নেতার ঘনিষ্ঠ, তা নিয়েও জনশুনানি হোক। তা হলেই সব স্পষ্ট হয়ে যাবে।’’
সব দলের নেতাই উদ্বিগ্ন। তবুও নদী দখল হয়ে যাচ্ছে। এটা কোনও ভাবে আটকানো যায় কি না, সেই প্রশ্ন তুলেছেন হিমালয়ান নেচার অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার ফাউন্ডেশনের মুখপাত্র অনিমেষ বসু। তিনি বলেন, ‘‘আমরা কনভেনশন করেছি। সেখানে বিশিষ্ট সাহিত্যিক অশ্রুকুমার শিকদারও আক্ষেপ করেন, সরকারি তরফে কোনও দিন কিছু হয়নি। এখনও সব সম মনোভাবাপন্নকে নিয়েই এগোব।’’
তা হলে প্রশাসন কি করছে! জেলা ভূমিসংস্কার দফতরের এক আধিকারিক জানান, কোথাও স্পষ্ট অভিযোগ পেলেই নথিপত্র তলব করে আইনি প্রক্রিয়া নেওয়া হয়। কিন্তু, আদালতে মামলার জেরে অনেক ক্ষেত্রে জমি থেকে উচ্ছেদ থমকে গিয়েছে বলে তাঁদের দাবি। দার্জিলিঙের জেলাশাসক অনুরাগ শ্রীবাস্তব জানান, তাঁরা অভিযোগ পেলেই খতিয়ে দেখেন। অনেক বেআইনি নির্মাণ ভেঙেওছেন। কিছু দিন আগেই সেবকে তিস্তার চর দখল করে রিসর্ট তৈরির কাজ অনেকটা করে ফেলেছিল কলকাতার একটি সংস্থা। জেলাশাসকের নির্দেশে সেটি ভেঙে দেওয়া হয়।
কিন্তু গত এক বছরে দখলমুক্তির দৃষ্টান্ত মোটে এক। দখলের নজির ১৬টি নদীর অন্তত ১৬০টি জায়গায়। তাই নদীগুলির ভবিষ্যৎ ভেবে পরিবেশপ্রেমীরা শিউরে উঠছেন।