জিলা স্কুলের ছবিটি তুলেছেন সন্দীপ পাল।
জেলা শহর হওয়ার পর ৩৩ বছরের মধ্যে পাকা স্থাপত্য গড়ে উঠেছিল চারটি। সে সময় তৈরি হওয়া একটি কাঠের প্ল্যাঙ্কিনের একটিমাত্র বাড়ি এখনও রয়েছে। ১৮৮৩ সালের ৮ নভেম্বর কোচবিহারে মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ সিংহাসনে বসলেন। তখন জলপাইগুড়ি শহরের সঙ্গে এখনকার বাংলাদেশের বোদা, চাকলাজোত (চাকুলিয়া) এলাকার লোকজনেরও যোগাযোগ ছিল। সে সময় কোচবিহারে যাওয়া তখন কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিল। তাই নৃপেন্দ্রনারায়ণের অভিষেকের সময় তাঁরা যাতে জলপাইগুড়িতে এসে আনন্দ ফূর্তি করতে পারেন সে জন্য কোচবিহার রাজের পক্ষ থেকে একটা আস্ত কাঠের প্ল্যাঙ্কিনের বড় ঘর তৈরি করে দেওয়া হল। প্রজারা এসে সেখানে থেকে সাত দিন ধরে আনন্দফূর্তি করতেন। বাড়িটির নাম হয় ‘নৃপেন্দ্রনারায়ণ হল’। যা আজও সমান ঐতিহ্য বহন করে চলেছে।
জলপাইগুড়ি পূর্ত দফতরের অফিসের উল্টো দিকে অবস্থিত এই বাড়িটিতে বর্তমানে রাজ্য সরকারের একটি অফিস আছে। জলপাইগুড়ির প্রথম পুরসভা, প্রথম ইউনিয়ন বোর্ডের (বর্তমানের জেলাপরিষদ) সূত্রপাত এবং বেঙ্গল ব্যাঙ্কের শাখা এখান থেকেই চালু হয়। পরবর্তীতে এই কাঠামোটি ভেঙে পাকা বাড়ি তৈরি করতে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগী নেওয়া হয়েছিল। জলপাইগুড়ি হেরিটেজ সোসাইটির বাধা দানের ফলে বাড়িটি এখনও অক্ষত আছে। ওই কমিটির সদস্য উমেশ শর্মা, অরূপজ্যোতি মজুমদাররা তীব্র প্রতিবাদ করায় সরকার পিছিয়ে যায়। উমেশ শর্মা বলেন, “বাড়িটির কোনও ক্ষতি হয়নি। যে রকম ছিল সে রকমই আছে। কোচবিহার রাজ্যের একমাত্র চিহ্ন এই বাড়িটি। এ রকম একটি বাড়ি এবং জলপাইগুড়ির পুরনো স্থাপত্যগুলি ভেঙে ফেলার বিরোধী আমরা। আমরা চাই এগুলি রক্ষণাবেক্ষণ করে বাঁচিয়ে রাখা হোক।” শুধু তাই নয়, জলপাইগুড়ি শহরে কোচবিহার রাজের একমাত্র স্মৃতিচিহ্ন নৃপেন্দ্রনারায়ণ মেমোরিয়াল হলটিকে জাদুঘর তৈরির জন্য প্রস্তাব করেছেন কোচবিহার হেরিটেজ সোসাইটির সম্পাদক অরূপজ্যোতি মজুমদার। তিনি বলেন, “সরকারি অফিস তুলে দিয়ে এই ঐতিহ্যের বাড়িটিকে জাদুঘরে পরিণত করা হলে জলপাইগুড়ির বাসিন্দারা পুরনো জলপাইগুড়ি সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারবেন।”
পাকা বাড়ি তৈরির বিষয়ে জলপাইগুড়ি রাজাদের অবস্থানও কঠোর ছিল। তাঁরা চাইতেন না যে কেউ পাকা বাড়ি তৈরি করুক। জলপাইগুড়ি শহরের একজন ব্যবসায়ীর সাধ হল তিনি নিজে একটি পাকা মুসাফিরখানা তৈরি করবেন। বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় তখন জলপাইগুড়ি রাজা ছিলেন ফণীন্দ্রদেব রায়কত। তিনি বাধা দিলেন। তবে পাল্টা মামলা করলেন সোনাউল্লা। জিতলেনও সোনাউল্লা। ১৯০৯ সালে তৈরি হল সাধের মুসাফিরখানা। সেই মুসাফিরখানাকে নিয়েই পরে তৈরি হয় সোনাউল্লা স্কুল। এর পরে ১৯০২ সালে জলপাইগুড়িতে তৈরি হয় একটি ব্যাঙ্ক এবং জলপাইগুড়ি সদর হাসপাতাল। তবে ব্যাঙ্কটি বেঙ্গল ব্যাঙ্কের শাখা না ইম্পিরিয়াল ব্যাঙ্কের শাখা তা নিয়ে মতো বিরোধ আছে। কেন না, আনন্দগোপাল ঘোষ মনে করেন, শাখাটি ইম্পিরিয়াল ব্যাঙ্কের শাখা। অন্য মতটি বলছে ইম্পিরিয়াল ব্যাঙ্ক তৈরি হয় ১৯২৪ সালে। তবে ১৯০২ সালে এটি বেঙ্গল ব্যাঙ্কের শাখা ছিল। ১৯২৪ সালে বেঙ্গল ব্যাঙ্ক, বোম্বে ব্যাঙ্ক এবং ম্যাড্রাস ব্যাঙ্ক তিনটি নিয়ে ইম্পিরিয়াল ব্যাঙ্ক তৈরি হয়। পরবর্তীকালে এই ইম্পিরিয়াল ব্যাঙ্কই ভারতীয় স্টেট ব্যাঙ্ক নামে পরিচিতি লাভ করে। বিতর্ক যাই থাক বর্তমানে স্টেট ব্যাঙ্কের জলপাইগুড়ি শাখার ম্যানেজারের আবাসস্থল এই বাড়িটি। ব্যাঙ্কের মুখ্য ব্যবস্থাপক বিজনকুমার দাস বলেন, “তিন বছর আগে বিশ্বকর্মা পুজোর দিন ভূমিকম্পের ফলে বাড়িটির চুনসুরকির পলেস্তারা কিছুটা খসে পড়েছিল। এই বাড়িটি আমাদের ব্যাঙ্কের গর্ব।’’ ১৯১১ সালে তৈরি হয়েছিল আর একটি স্থাপত্য জলপাইগুড়ি রাজবাড়ি। তিন বছর আগের ভূমিকম্পে একটি অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সেই অংশটি এখন ভেঙে ফেলা হচ্ছে।
তবে এ বারের ভূকম্পে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে জিলা স্কুল। স্থাপিত হয়েছিল ১৮৭৬ সালে। ১৯১৪ সালে এই স্কুলের লালরঙের বাড়ির একটি হলঘর-সহ ১৪টি ঘর তৈরি হয়। ভূমিকম্পে পাঁচটি ক্লাসঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তার মধ্যে দু’টির এমন অবস্থা যে তালাবন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। স্কুলের দু’জন প্রাক্তন ছাত্র তথা পূর্ত দফতরের নির্বাহি বাস্তুকার মৃণাল কুণ্ডু এবং জেলাপরিষদের জেলা বাস্তুকার অরিন্দম ভট্টাচার্য এসে ঘুরে দেখে গিয়েছেন। স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র এবং প্রধান শিক্ষক ধীরাজ ঘোষ বলেন, “ভেঙে নতুন করে করার আমরা বিরোধী। ভেঙে ফেললে এই ঐতিহ্যবাহী বাড়িটি কৃষ্টি সংস্কৃতি সব নষ্ট হয়ে যাবে।”